আল্লামা আবু তাহের কাসেমী নদভী (হাফিজাহুল্লাহ)
সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি :
জন্ম :
বিদগ্ধ এই মনীষী ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত উত্তর নিশ্চিন্তাপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম নজীর আহমদ সাহেব। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ধার্মিক।
শিক্ষা-দীক্ষা:
তিনি পারিবারিকভাবে দ্বীনি পরিবেশে বেড়ে ওঠায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার ওস্তাদ ছিলেন গৃহশিক্ষক রাঙ্গুনিয়াবাসী হযরত মাওলানা ক্বারী হারুন সাহেব। অতপর তিনি স্নেহের ছাত্র আবু তাহেরকে নিজ দায়িত্বে ভর্তি করে দেন ফটিকছড়িস্থ ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুর-এ। সেখানে তিনি এক বছর অধ্যয়ন করে ছুটে যান রাঙ্গুনিয়া থানার চন্দ্রঘোনা ইউনুছিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে হাপ্তুম পর্যন্ত মোট চার বছর লেখা পড়ার পর পুনরায় পাড়ি জমান জামিয়া ওবাইদিয়া নানুপুর মাদ্রসায়। শাশুম থেকে চাহারুম পর্যন্ত মোট তিন বছর অধ্যয়ন করেন সেখানে। অতঃপর এলেমের টানে ছুটে আসেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ইসলামি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায়। ভর্তি হন জামাতে ছুয়ামে। এখানে তিনি ১৪০১ হি. দাওরা ও ১৪০২ হি. তে ইফতাসহ মোট পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন।
অধ্যয়নকালে তিনি অত্যন্ত শ্রম-সাধনা ও মুজাহাদার পাশাপাশি উস্তাদ ও মুরব্বিদের সুনজর ও স্নেহ পরশে ধন্য হন। তাই বিশেষভাবে ফকীহুল মিল্লাত রহ. তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। এটুকুতেই এই মহান জ্ঞানপিপাসু তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারেননি। তিনি তাঁর তালিমি ও তারবিয়াতি মুরব্বি ফকীহুল মিল্লাত রহ.-এর পরামর্শক্রমে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে ১৪০২ হিজরিতে পাকিস্তানে ইফতা পড়ার জন্য যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে যাত্রা বিরতি করলেন উপমহাদেশের দ্বীনি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দে। বিশেষ কারণে তখন রমজানে বুখারি শরিফের দরস চলছিল। দরস প্রদান করছিলেন হযরত মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.। ইলমের পিপাসু তাঁর দরসে অংশগ্রহণ করে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হন যার ফলে ১৪০৩ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দে পুনরায় দাওরা পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেন এবং হযরত পালনপুরী সাহেবের নিকট বিশেষভাবে এলমি ইস্তিফাদা লাভ করেন। অতঃপর আন্তর্জাতিক অদ্বিতীয় আরবি সাহিত্যিক
আল্লামা সুলতান যওক নদভী দা.বা. এর পরামর্শক্রমে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম আরবি সাহিত্যিক মুবাল্লেগে ইসলাম আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর সুহবত ও ইলমি ইস্তেফাদার লক্ষ্যে নদওয়াতে আরবি আদব পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তিনি ১৪০৪ হিজরিতে গমন করেন ভারতীয় উপমহাদেশের আযাদি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সংগ্রামী সাধক সৈয়দ আহমদ বেরলভী রহ. এর জন্ম ও তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা কেন্দ্র খানকায়ে রায় বেরেলভীতে। উদ্দেশ্য ছিল শায়খুল আরব ওয়াল আজম মাওলানা আলী নদভী রহ. এর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হওয়া এবং নদওয়াতুল ওলামা লখনৌতে উচ্চতর আরবি সাহিত্য নিয়ে পড়া। কিন্তু আদব বিভাগে আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ায় তিনি নিয়মতান্ত্রিক ভর্তি হতে পারছিলেন না। কিন্তু মহামনীষী আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তাঁর আনুগত্য, তাকওয়া, মুজাহাদা দেখে শিক্ষা পরিচালকের নিকট তাঁর জন্য সুপারিশ করেন বাংলাদেশী ছাত্রদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম এ সৌভাগ্য ও সুযোগ পান। তিনি ১৪০৪-০৫ হিজরিতে দুই বছর অত্যন্ত সফলতা, সাধনা ও কঠোর প্রচেষ্টার বিনিময়ে আদবে আরবি কোর্স সম্পন্ন করেন।
অধ্যাপনা :
দেশ-বিদেশে মহামনীষীদের সান্নিধ্যে দীর্ঘ দিন থেকে ইলম অর্জন করার পর ১৪০৬ হিজরি সনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরে আসার অন্তিম মুহূর্তে আলী নদভী রহ. তাকে আল্লামা সুলতান যওক নদভী দা.বা. এর কাজ-কর্মে সহযোগিতা করার পরামর্শ দেন। অতঃপর তাঁর শায়খ ও উস্তাদ ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান রহ. এর প্রস্তাব ও ব্যক্তিগত ইস্তিখারা এবং বিশিষ্টজনের পরামর্শক্রমে তিনি এ জামেয়ার খেদমতের জন্য আত্মনিয়োগ করেন। তখন ছিল মুহাররম মাস। জামিয়াতে খেদমতের ব্যবস্থা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রূম ও বেতনের কোন ব্যবস্থা হয়নি। এভাবে চলে গেল দীর্ঘ ৮ মাস। তিনি নিজেও কোন দিন কোন দাবি মাদ্রাসার কাছে করেননি। ঠিক আগের মতোই মায়ের টাকা দিয়ে খরচ চালাতেন। দাবি করবেনই বা কেন? তাঁর সবর, তাকওয়া ও তাওয়াক্কুলই ছিল তাঁর আজীবনের ভূষণ ও পাথেয়। পরে তাঁকে জামিয়ার দফতর থেকে একত্রে ১০,০০০ টাকা প্রদান করা হয়। দীর্ঘ দিন এত অব্যবস্থা ছিল তাঁর জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। এর পরের বছর মাসিক এক হাজার টাকা করে তাঁর বেতন নির্ধারিত হয়। অদ্যাবধি নিভৃতচারী এই সাধক আধ্যাত্মিকতা, আন্তরিকতা, তাকওয়া ও ইখলাসকে জীবন পথের পাথেয় করে প্রচুর শ্রম ও নিরলস সাধনার মাধ্যমে এ জামেয়াতে হাদীস, ফেকাহ, আরবী সাহিত্যের উচ্চতর কিতাবসমূহ অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে পাঠদান করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি জামিয়ার নায়েবে মোহতামিম ও জামিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দীর্ঘ ৩০ বছর খেতাবতের জিম্মাদারী পালন করে আসছেন এবং জামিয়ায় দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধরে দারুল ইকামার নাজেম (ছাত্রাবাস সুপার) হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা, সততা ও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন। তাঁর দক্ষ হাতের সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল পরিচালনার ফলে জামিয়ার ছাত্রাবাসে বিরাজমান সুশৃঙ্খল, সুন্নতি ও জান্নাতি আমলী পরিবেশ সারা দেশের অনন্য মডেলরূপে পরিগণিত হয়েছিল।
আধ্যাত্মিকতা :
আলোকিত এই ‘মাটির মানুষটি ছাত্র জীবন থেকেই সাধনাজগতের সিংহপুরুষদের সাথে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক বজায় রাখতেন। প্রথমে তাসাউফের সবক নেন হযরত হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর সর্বশেষ খলিফা হযরত মাওলানা আবরারুল হক হারদুয়ি রহ. এর হাতে। তাঁর সাথে ছাত্র জীবন থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর মৃত্যু অবধি ইসলাহী সম্পর্ক জুড়ে ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান রহ. এর হাতে বায়াত নেন। এবং উভয় বুজুর্গের সাথেই তার রুহানি ইসলাহী নিসবত ও সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় থেকে নিবিড় ছিল।
যে সমস্ত বুজুর্গদের বিশেষ পরশ পেয়ে তিনি ধন্য হয়েছেন, খতিব আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ রহ. শাইখুল আরব ওয়াল আযম মাওলানা হাজি ইউনুস রহ. যুগের বোয়ালি কলন্দর মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালবি রহ, ফকিহুল মিল্লাত মাওলানা মুফতি আবদুর রহমান রহ. হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারী মোঃ তৈয়ব সাহেব রহ. ফেদায়ে মিল্লাত মাওলানা সৈয়দ আসাদ মাদানি রহ. ফকিহে উম্মত মুফতি মাহমুদুল হাসান গুঙ্গহী রহ. মুবাল্লেগে ইসলাম সৈয়দ মাওলানা আবুল হাসান আলিমিয়া নদভী রহ.|
রচনাবলী :
ইলম ও আমলের এই নিরলস সাধক কলম হাতেও পিছিয়ে নেই। তিনি রচনা করেছেন যুগোপযোগী বহু গ্রন্থ। তন্মধ্যে রয়েছে:
(১) দুরুসুল লুগাতুল আরবীয়া (১ম, ২য়)
(২) আমার দেখা লন্ডন (সাড়া জাগানো ভ্রমণ কাহিনী)
(৩) কওমি মাদ্রাসা কী ও কেন?
(৪) হাম কোন হেঁ, হামারে যিম্মাদারী কিয়া হেঁ?
(৫) তামরিনুল মিযান ওয়াল মুশায়িব
(৬) তাযকিরায়ে শাহ্ আলী আহমদ বোয়ালভী রহ.
(৭) মিম্বরের আহ্বান।
তিনি বিগত ০৩/০৮/১৪৪৫ হিজরী মুতাবেক ১৪/০২/২০২৪ ইংরেজী (বুধবার) জামিয়ার শোরা কমিটির সর্বসম্মতিক্রমে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। আকাবির ও আসলাফের প্রতিচ্ছবি, জামিয়ার দরদী মালী, ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, ছাত্র-উস্তাদ সকলের আস্থাভাজন মুখলিস মুরুব্বী। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দীর্ঘয়ু করুন এবং জাতির রাহবর হিসেবে কবুল করুন, আমীন।