কুতবে যামান আল্লামা মুফতী আযীযুল হক (রহ.) সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম
কুতবে যামান আল্লামা মুফতী আযীযুল হক রহ.। আধ্যাত্মিক জগতের জ্যোতিষ্মান নক্ষত্র। দক্ষ ফিকাহ্বিদ। আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষার সুদক্ষ লেখক ও কবি। ইলমে দীনের এক বড়বৃক্ষ ও মহীরুহ। বক্তৃতার ময়দানের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তা। লেখালেখির ময়দানের সফল লেখক। পরিচালনার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব দক্ষ কারিগর। তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষা-দীক্ষা ও অনুসারিত পথ অবলম্বন করে এবং তাঁর রূহানী তাওয়াজ্জুহ্কে সম্বল বানিয়ে এদেশের মুসলিম সমাজ পেতে পারে পার্থিব বিকাশ ও মুক্তির পথ। পরকালীন শান্তির পাথেয়। আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। জামিয়ার সূচনলগ্ন থেকে আমৃত্যু প্রায় ২২ বছর দক্ষ পরিচালক। জামিয়ার ফতওয়া বিভাগে তিনিই সর্ব প্রথম কাজ করেছেন। তাঁর তত্তাবধানেই পরিচালিত হতো ফিকহ ও ফতওয়ার কাজ। তাঁর লিখিত অনেক ফতওয়া জামিয়ার ফতওয়া বিভাগে সংরক্ষিত আছে। যুগশ্রেষ্ঠ এ সাধক পুরুষ ১৩৮০ হি. মোতাবেক ১৯৬১ ইং সনের ১৫ রমজান ইহধাম ত্যাগ করেন। ফতওয়া সংকলন ও প্রকাশের শুভ মুর্হূতে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম আলোচনা করা হলো।
পারিবারিক পরিচয় ও বংশ পরম্পরা :
আল্লাহ পাক হযরত মুফতী আযীযুল হক রহ. চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে পয়দা করেছেন, প্রাচীনকাল থেকে এ পরিবার সিদ্দিকী পরিবার হিসেবে খ্যাত। সুতরাং তিনি সিদ্দিকী বংশীয়। তিনি নিজেই লিখেছেন, আমি বংশের দিক থেকে সিদ্দিকী, আমাদের বংশীয় পরিচয় প্রাচীন যুগ থেকে শেখ সিদ্দিকী হিসেবে প্রসিদ্ধ। হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর মরহুম পিতা মাওলানা নূর আহমদ সাহেব চট্টগ্রামের তৎকালীন সুপ্রসিদ্ধ ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুহসেনিয়া মাদরাসার সনদপ্রাপ্ত সুদক্ষ আলেম ছিলেন। তাঁর পিতামহ জনাব মুনশী সুরত আলী সাহেব এলাকার একজন প্রভাবশালী জমিদার হবার সাথে সাথে বাংলা ভাষার পারদর্শী ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তাঁর মাতা গুলজার বেগম একজন সহজাত মেধাসম্পন্ন ধর্মপরায়ন ও সতী-সাধবী গৃহিনী ছিলেন। কতইনা সৌভাগ্যবান সেই গুলজার (কুসুম বাগান) যার উপর দিয়ে বয়ে গেছে রহমতের শীতল বায়ু এবং ফুটেছে সেই রক্তাক্ত গোলাপ, যার ¯িœগ্ধময় সৌরভ লাখো মানুষের মন মস্তিষ্ককে করেছে সুরভিত।
জন্মের শুভক্ষণ ও অদৃষ্ট সুসংবাদ:
জনাব মুনশী সূরত আলী নিজের বিদ্বান পুত্র নূর আহমদকে শাদী করানোর পর অধীর আগ্রহে ছিলেন কখন একজন সম্ভাবনাময় নাতির জন্ম হবে। তাঁর আকাক্সক্ষার কাফেলা উর্দ্ধজগতে গিয়ে আসমানের দরজায় ঠোকা দিতে লাগলো। এরই মাঝে তিনি এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন যে, খুবই সুন্দর ও মোহনীয় অবয়বে সূর্য উদয় হচ্ছে। অপর দিকে চাঁদ অস্ত যাচ্ছে। পুত্রবধু অন্তসত্তা থাকাতে স্বপ্নের প্রথমাংশে (সূর্যোদয়) নাতির জন্মেও স্পষ্ট সুসংবাদ বুঝা গেলেও দ্বিতীয়াংশ (চন্দ্রাস্ত) এক অজানা আশংকা সৃষ্টি করেছিলো মুনশী সাহেবের মনে। আস্তে আস্তে তার আশা পূরণ হলো। মাওলান নূর আহমদের ঘরে উদিত হলো ইলম ও মারেফাতের সেই সূর্য, যার অসংখ্য রশ্মিমালা পুরো দুনিয়াকে উজ্জ্বল করেছে। মুনশী সাহেব তার ¯েœহাস্পদ নাতি ও পুরো পরিবারের অতি প্রিয় পাত্রের নাম আযীযুল হক (আল্লাহর প্রিয়) রাখলেন। সত্যিই এই নবজাত শিশু পরবর্তিতে আল্লাহর অতি প্রিয় বান্দায় পরিণত হলো। দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে যেমন প্রত্যক্ষ্য করেছে এ সুর্যের উদয়লগ্নে আলো ঝলমল পরিবেশ তেমনি অবলোকন করেছে মধ্যাগগনে অবস্থান কালে ও অহ-নিশির প্রতি মুহুর্তে আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরণের মনোরম দৃশ্য। যেমন শুরু তেমন শেষ। কবির ভাষায়:
دیکھ اپنے شاندار آغاز کا انجام دیکھ
ناز تھا جس صبح نورانی کا اسکی شام دیکھ
যে আলোকময় প্রভাত গর্বের বস্তু ছিলো তাঁর অন্তিম মুহুর্ত লক্ষ্য করো। দীপ্ত সূচনার সুসমাপ্তি লক্ষ্য করো।
অদ্ভুত মিল :
দেশের প্রচলিত হিসাবে সংরক্ষিত হযরত মুফতী সাহেবের জন্ম তারিখ ছিল ১৩২৩ হিজরী সন মোতাবেক ১৯০৫ ইংরেজী। আশ্চর্যজনকভাবে ঐ বছর জগৎবিখ্যাত বুযুর্গ সহজাত ইসলামী আইনজ্ঞ হযরত আল্লামা মুফতী রশীদ আহমদ গাংগুহি রহ. ইন্তেকাল করেন। তখন বাংলাদেশ নামের কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্টিত হয়ানি। স্বয়ং পাকিস্তান ছিলো ভারতেরই অংশ। সুতরাং নিখিল ভারতের একাঞ্চলে এক সভাবজাত ফকীহ ও কুতুবের ইন্তেকাল হচ্ছে এবং অন্যঞ্চলে আরেক স্বভাবজাত ফকীহ ও কুতুবের জন্ম হচ্ছে, যিনি কিছুকাল পরে এ বাংলায় হযরত গাংগুহির ফয়েজ বরকতের কেন্দ্রবিন্দু হবার সৌভাগ্য লাভ করবেন।
এতিমত্বের উত্তরাধিকার :
রাহমাতুল লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ সাচ্চা আশেক তাঁর কাছ থেকে আরো অসংখ্য গুণাবলির মতো এতিমত্বও উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করেন। মাত্র এগারো মাস বয়সে তাঁর পিতা হযরত নূর আহমদ রহ. আনুমানিক পয়ত্রিশ বছর বয়সে জান্নাতবাসী হন। এটা ছিলো তাঁর দাদা মুনশী সূরত আলীর দেখা স্বপ্নের দ্বিতীয়াংশের বাস্তবরূপ। পিতৃবিয়োগের পর তাঁর সৃহৃদ দাদা চাচাদ্বয় মুনশী নূরুন্নবী ও মুনশী নূরুল হক তাঁর লালন পালনের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তদীয় ¯েœহ ক্রোড়ে ও সুনিপুন তত্ত¡াবধানে তিনি এমন আনন্দঘন পরিমন্ডলে লালিত পালিত হন যে, পিতৃঅভাব অনুভব করেননি কোন দিন। আল্লাহ তাদের যথাযথ প্রতিদান দিন। দাদার জীবদ্দশায় বাবার ইন্তেকালে বৈষয়িক সম্পদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও আসমানে যে উত্তরাধিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে তার তুলনায় এ ধন সম্পদ ও জায়গা জমি একেবারে তুচ্ছ।
প্রাথমিক শিক্ষা :
হযরত মুফতী সাহেব রহ. দাদা ও চাচাদ্বয়ের কড়া তত্ত¡াবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সরকারি স্কুলেই অর্জন করেন। সাথে সাথে কুরআন শরীফ ও প্রাথমিক দ্বীনিয়াতের কিতাব সমূহও পড়েন। প্রখর ধীশক্তি ও জন্মগত মেধার টানে তাঁর লেখা পড়া দ্রæতই অগ্রসর হচ্ছিলো। বাংলা-ইংরেজী তথা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বশেষ ধাপ অতিক্রম করার উপক্রম হয়েছিলো। তার উপর আত্মীয়-স্বজন ও শিক্ষক এবং গুরুজনদের দৃষ্টি নিবন্ধ হয়েছিঁলো। কিন্তু অন্য দিকে অদৃষ্টের সবল হাত কর্মতৎপর ছিলো। যাকে আল্লাহর ইলম ও মারেফাতের অমূল্য ধন-ভাÐার সোপর্দ করার জন্য কুদরতের নজর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে চলেছে, তার গতিরোধ কীভাবে করতে পারে তথাকথিত বস্তুবাদী সভ্যতা ও বৈষয়ীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবর্জনাস্তুপ? অবশেষে তাকে যে কাজের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে সেদিকে অগ্রসর হওয়ার সমুদয় উপকরণ যোগাড় হতে লাগলো। হাদীসে আছে كل ميسر لما خلق له“অর্থাৎ যাকে যে জন্যে সৃষ্টি করা হয় তারপথও সুগম করে দেওয়া হয়।”
দ্বীনি শিক্ষার পথে :
দাদা মুনশী সুরত আলী তাঁর জন্মের পূর্বেই মান্নাত করেছিলেন যদি নাতী হয়, তাহলে তাঁকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দ্বীনের সেবাব্রতে ওয়াকফ করে দেবো। এখন তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, কিভাবে মান্নাত পুরা করা যায়। তাই তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষার উৎসাহ দিতে লাগলেন। তাঁর আম্মাজানও তাঁকে প্রতিনিয়ত দ্বীনি শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। মাঝে মধ্যে তাঁর মরহুম পিতার কিতাবাদি দেখিয়ে বলতেন,“বৎস! এগুলো তোমার আব্বার কিতাব। তোমার জন্যে রেখে গেছেন, ইনশাআল্লাহ এগুলো তোমাকে পড়তে হবে। কখনো কখনো অতিশয় আবেগে তাঁর আব্বার বিশেষ পোশাক; কোর্তা ও আচকন ইত্যাদি বের করে তাঁর শরীরে রাখতেন। কে জানে তখন তাঁর আম্মার হৃদয় জগত হতে কতই আবেগ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো উত্তাল পাতাল হয়ে যেতো। কোনো কোনো আত্মীয় তাঁর দাদা মুনশী সাহেবকে পরামর্শ দেন যে, ছেলেটা অত্যন্ত মেধাবী। তাকে ইংরেজী পড়ালে একজন সফল জজ হয়ে গোষ্ঠির সুনাম বৃদ্ধি করতে পারবে। মুনশী সাহেব কিন্তু কিছুই শুনলেন না। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললেন, আমার আখেরাতের জজ দরকার দুনিয়ার নয়”
মাদরাসায় ভর্তি :
অতঃপর তাকে কৈয়গ্রাম হেমায়াতুল ইসলাম মাদরাসায় ভর্তি করানো হলো। তথায় এক বছরের মতো শিক্ষা লাভ করে তিনি জিরি ইসলামিয়া মাদরাসায় চলে আসেন। উল্লেখ্য জিরি মাদরাসা ১৩১০ হিজরি সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এ মাদরাসায় কোন সনে ভর্তি হয়েছিলেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এটা জানা গেছে যে, যে বছর তিনি ‘মীযান’ শুরু করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিলো দশ বছর। আর এটা হচ্ছে তেরশ তেত্রিশ হিজরির ঘটনা। বস্তুত এখান থেকেই নিয়ম তান্ত্রিক ভাবে তাঁর পাঠ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
দেশে তাঁর শিক্ষকমণ্ডলি :
জিরি মাদরাসায় তাঁর উস্তাদগণ তাঁকে অত্যান্ত ¯েœহ করতেন তাঁর মেধাবী শক্তিও আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতাকে অমূল্য রতœ গণ্য করে তাঁর কাছ থেকে অধিকতর কাজ নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করতেন। তাঁর মাননীয় শিক্ষকমÐলির মধ্যে জিরি মাদরাসার প্রাতষ্ঠাতা পরিচালক হযরত মাওলানা আহমদ হাসান রহ., মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সন্দিপী রহ. মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব তুলাতুলি রহ. মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল সাহেব রহ. (আনোয়ারা) ও শাহমীরপুর তাজবীদুল কোরআন মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ক্বারী আব্দুল মাজিদ সাহেব রহ. এর নাম উল্লেখযোগ্য। এসব খ্যাত উস্তাদ মন্ডলীর আন্তরিক দোয়া ও নিপুণ শিক্ষা-দীক্ষায় তাঁর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশিত হতে লাগলো।
উস্তাদের প্রতি অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং বিষেশ দুআ অর্জন :
হযরত মুফতী সাহেব রহ. জিরি মাদরাসার পাঠ্যকালীন সময়ে বাংলার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও জিরি মাদরাসার শাইখুল হাদীস হযরত মাওলাানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব রহ. (ওফাত ১৩৮৭ হি.) এর আধ্যাত্মিকতার নজরে পড়ে যান। হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহ. অসাধারণ জ্ঞানী-গুণী ও অতি নম্র-ভদ্র স্বভাবের ব্যক্তি ছিলেন। সুন্নতের অনুসরণ যেন তাঁর মজ্জাগত অভ্যাস ছিলো। এক কথায় তিনি ছিলেন জিরি মাদরাসার প্রাণপুরুষ। হযরত মুফতী সাহেবের মতো ঈর্ষনীয় ও গর্বের ছাত্র যখন তাঁর হাতের নাগালে আসে এবং আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতার চিহ্ন ও সহজাত ভদ্রতা-সততার মূর্ত প্রতীক তাঁর ললাটে দেখা গেলো, তখন তিনি অতিশয় আনন্দে ও একাগ্রচিত্তে শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে তাঁর জীবন সুসজ্জিত করার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। তাকে নিজের কক্ষে বিশেষ তত্ত¡াবধানে রাখলেন। হযরত মুফতী সাহেবও উস্তাদের এতই মান্য করতেন যে, অনুমতি বিনে উঠা বসাও করতেন না। তাঁর ইঙ্গিত ইশারায় পাঠ্য জীবন অতিক্রান্ত করলেন। যেন এ ফার্সি কবিতার বাস্তব রূপ তিনিই ছিলেন।
অর্থাৎ এমন কাছের মানুষ পেলে তার পায়ের ধুলো বনে যাও। তাঁর খাঁচায় স্বেচ্ছায় বন্দি হয়ে যাও।
হযরত মুফতী সাহেবকে তাঁর বৃদ্ধাবস্থায় (যখন তাঁর শিষ্য শাগরিদ ও ভক্ত অনুরক্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে) কোন সময় হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহ. পটিয়া আগমন করলে, তিনি একজন নগণ্য খাদেমের মতো অতি আদবের সাথে এক কোণে বসে থাকতেন। পেশাব পায়খানার ঢিলাকুল ও পানির বদনা নিয়ে নিজেই দৌঁড়াদৌঁড়ি করতেন। কোন ছাত্র বা শিক্ষককে এ দায়িত্ব সোপর্দ করতেন না, বরং তার মেহেরবান উস্তাদের খিদমতে অন্য কেউ ভীড় জমাক তিনি তা পছন্দ করতেন না। হযরত মুহাদ্দিস সাহেবের সান্নিধ্যকে তিনি অমূল্য নিয়ামত মনে করে সদা তাঁর সেবায় ব্যাস্ত ও বিদ্যার্জনে রত থাকতেন। অন্যন্য শিক্ষাগুরুদের প্রতিও তিনি ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। এটা তাঁর একটি অনন্য বৈশিষ্ট ছিলো। তিনি সব সময় বলতেন দুই এক শব্দ যা শিখেছি তা উস্তাদগণের ভাক্তি ও শ্রদ্ধার বদৌলতে শিখেছি।
হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহ. তাঁর ওফাতের পর কেঁদে কেঁদে বলেন- “¯েœহাস্পদ মুফতী আযীয সাহেব, যেমন ছিলেন বিচক্ষণ তেমনি ছিলেন অবস্থা পর্যবেক্ষণে পারদর্শী। পাঠ্য জীবনের দীর্ঘতম সময়ে এমন কোন আচরণ করেননি যা আমার অসন্তুষ্টির কারণ হয়। মানুষের সাথে অযথা মেলামেশা করতেন না। যখনই সময় পেতেন শিক্ষাগুরুদের সশ্রদ্ধ খেদমত করতেন। কাউকে দিয়ে পা টিপানো আমার অভ্যাস ছিলো না, কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়লে তিনি এসে চুপিসারে পা টিপে দিতেন।”
হযরত মুফতী সাহেব তাঁর স্বদেশী উস্তাদবৃন্দের মধ্যে হযরত মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন। আর হিন্দুস্তানের উস্তাদবৃন্দের মধ্যে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. ও হযরত মাওলানা আব্দুররহমান কামেলপুরি রহ. এর কথাই বেশি স্মরণ করতেন। উল্লেখ্য যে, হযরত মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব হযরত মুফতী সাহেবের ওফাতের পর কেঁদে কেঁদে এ কথাও বললেন যে, যখন থেকে মুফতী আযীয সাহেব আমার কাছে পড়তে আসেন সে সময় থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কখনো তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর ভুলতে পারিনি। বহু সময় নিজেরই সন্তান এযায,একরাম, এহসানের কথা মনে পড়তোনা, কিন্তু এমন সময় যায়নি যে, আযীযের কথা মনে পড়েনি।
জ্ঞানচর্চা ও সময়সূচি :
হযরত মুফতী সাহেব রহ. পাঠ্যজীবন থেকেই সৃশৃঙ্খল ও সময়ানুবর্তী ছিলেন। তিনি সময় সূচির বড়ই গুরুত্ব দিতেন। প্রত্যেক কাজ বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সঠিক সময়ে সম্পন্ন করতেন। তাঁর এ সুশৃংখল প্রক্রিয়া বড়দের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই পাঠ্য জীবনে তাঁকে জিরি মাদরাসার কিছু ব্যবস্থাপনার কাজ সোপর্দ করা হয়। প্রবাদ আছে, “যে পাখি উড়ে পাখা ঝাড়ে নীড়ে।” অধ্যয়ন-অধ্যবসায়ে ও জ্ঞানচর্চায় হযরত মুফতী সাহেব অন্যন্য ছাঁত্রদের তুলনায় ব্যতিক্রমী ছিলেন। বিগত আগত ও আসন্ন দিকের সবক মুতালাআ করা (পাঠ শেখা) তাঁর নিত্যদিনের কর্মসূচিভুক্ত ছিলো। মাদরাসা থেকে আবাসস্থল বা অন্য কোনো দূরবর্তী স্থানে যাওয়ার সময় কোনো বই পুস্তক অথবা নোটবুক তিনি সাথে রাখতেন এবং তা দেখে দেখে চলতেন। যখনই সুযোগ পেতেন কিতাব পড়তে বসে যেতেন। কিতাব পড়ার এমন মগ্ন হতেন যে, কখনো কখনো পথ ও ঘর ভুলে যেতেন। যখন অন্যন্য সাথীরা অযথা কথাবার্তা ও অলসতায় সময় নষ্ট করতো, তখন তাকে অধ্যয়নে মগ্ন দেখা যেতো।যে সময় তিনি জিরি মাদরাসায় অধ্যয়নরত, তখন সবেমাত্র বিমান চলাচল শুরু হয়েছিলো। প্রথমবারের মতো আকাশে বিমানের শব্দ শুনা গেলো। তাই সাধারণত ছাত্র শিক্ষক সবাই বিমান দেখার জন্যে মাঠে বের হয়ে পড়লেন। হযরত মুফতী সাহেব রহ. বলেন, আমিও বের হচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হলো বস্তুটা হয়তো বা পাখির মতো আকাশে উড়ছে, তাকে দেখে কিইবা লাভ হবে। অধ্যয়ন ছেড়ে বিমান দেখতে বের হওয়া একটি বেহুদা আচরণ, তাই আমি বসে বসে কিতাব দেখছিলাম। আমরা এ ঘটনা হযরতের মুখেও শুনেছি, মানুষের কাছেও শুনেছি। অধ্যয়নের গুরুত্ব বুঝাতে তিনি অতি আবেগে নি¤েœর কাব্যাংশটি আবৃতি করে শুনাতেন:
گھر میں بیٹھکر ملک کی سیر+ یہ تماشا ہم نے کتاب میں دیکھا
অর্থাৎ: ঘরে বসেই জগৎ ভ্রমন এ দৃশ্যটা দেখেছি কিতাবে।
পাঠ্যজীবনে শিক্ষকতা:
একনিষ্ঠ অধ্যয়ন স্পৃহা ও জ্ঞানার্জনের অদম্য সাধনার ফল হিসেবে ছাত্রজীবনেই তিনি শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেছেন। মাদরাসার কোন শিক্ষক দীর্ঘতম অনুপস্থিত থাকলে তাঁর নামের কিতাবগুলো যদি তাঁর পঠিত হয়, তাহলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাকে ঐসব কিতাব পড়ানোর জন্যে সাময়িকভাবে দায়িত্ব দিতেন। ছাত্ররাও তাঁর কাছে স্বআগ্রহে পড়ে খুবই উপকৃত হতো। এতদ্ব্যতীত কোনো কোনো মেধাবী ছাত্র সুযোগ মতো তাঁর কাছে এমন সব কিতাব পড়ে নিতো, যেগুলো মাদরাসায় পড়ানো হতোনা।
ছাত্রজীবনে প্রতিভার সুখ্যাতি:
আল্লাহ পাক তাকে অসাধারণ জ্ঞান, তীক্ষবুদ্ধি, সহজাত মেধা, স্বচ্ছ চিন্তা, বিরল অন্তদৃষ্টি ও অনন্য ধীশক্তির অধিকারী করেছিলেন। বাংলার ইতিহাসে এরকম বহুমুখী প্রতিভার অস্তিত্ব নিতান্তই বিরল। ছাত্রজীবনেই তাঁর মেধাশক্তির সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি একটিবার তাকে দেখার জন্যে ব্যকুল হয়ে পড়তেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই জিরি মাদরাসা ও তাঁর শিক্ষক মহোদয়গণের প্রতি অনেকের ঈর্ষা জাগতে লাগলো। এমনকি অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যাক্তির অন্তরে এক চঞ্চল আকাংখার উদ্রেক হতে লাগলো এ উদিয়মান বাচ্চাটা আমাদের ভাগ্যে জুটতো।
আমাদের শ্রদ্ধেয় উস্তাদ ও হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর বিশেষ খলীফা হযরত মাওলানা বদিউররহমান সাহেবের (মৃত ১৪০৫ হিজরী) মুখে শুনেছি যে, ১৩৬০ হিজরী সনে একবার হাটহাজারি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ সাহেব রহ. এর সাথে হযরত মুফতী সাহেবের সাক্ষাত হলে তিনি স্ব¯েœহে বললেন: আযীয! তুমি যদি হাটহাজারিতে পড়তে খুবই ভালো হতো। উল্লেখ্য এসব বুজুর্গানে দ্বীন কখনো নিজের ছাত্র ও গুণগ্রাহী বাড়ানের আগ্রহী ছিলেন না, তবে যার হৃদয়কে ঈমানী চাষের উপযুক্ত ক্ষেত্র বলে মনে করতেন তার দিকে তারা হুমড়ে খেয়ে অগ্রসর হতেন, কেননা তারাই তো প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেই যোগ্য উত্তরসুরী যাদের সম্পর্কে কুরআনে করীমে এসেছে।
حريص عليكم بالمؤمنين رؤوف رحيم
অর্থাৎ- আমাদের নবী তোমাদের ঈমানের জন্যে অতি আগ্রহী, মুমিনদের প্রতি অত্যান্ত দয়াবান ও সদয়।
দাওরায়ে হাদীস ও সম্মানসূচক পাগড়ী:
জিরি মাদরাসা যা ১৩১০ হিজরী একটা সাধারণ মক্তব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, পরবর্তীতে উপমহাদেশের একটি বিরাট শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়ে ইসলামী দুনিয়া থেকে প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছে এবং এমন প্রতিভাধর ওলামা-মাশায়েখের জন্ম দিবে, যাদের জ্ঞান-গরিমার ঝর্ণাধারা আজম থেকে আরব পর্যন্ত প্রবাহিত হবে। কেইবা জানতো যে, জিরির মতো নিভৃত পল্লির কুঁড়েঘর থেকে হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেবের মতো আলেমে রব্বানীর সৃষ্টি হবে। বালাবাহুল্য যে, যখন ঐ বিদ্যাপীঠের যৌবন পরিক্রমা শুরু হতে চলছেলো তখনই হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর শিক্ষা জীবন আরম্ভ হচ্ছিলো। একসময় তিনি সেখানে এসে ভর্তি হলেন।হযরত মুফতী সাহেব রহ. জিরি মাদরাসায় যে বৎসর মিশকাত শরীফ পড়ছিলেন সে বৎসরের শেষান্তে মাদরাসার প্রধান পরিচালক (মুহতামিম) হযরত মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব রহ. এক ঐতিহাসিক ঘোষণা শুনিয়ে দিলেন যে, ইনশাআল্লাহ আগামী বৎসর আমাদের মাদরাসায় দাওরা হাদীস শরীফের পাঠদান শুরু হবে। সুতরাং মিশকাত শরীফ অধ্যয়ণরত ছাত্ররা যেনো আগামী বৎসর দাওরায়ে হাদীস এখানে শেষ করার জন্যে মনস্থির করে। কিন্তু হযরত মুফতী সাহেব রহ. ব্যতীত কোন ছাত্রই এখানে দাওরায়ে হাদীস পড়তে আগ্রহী ছিলো না। তাই একে একে সবাই হিন্দুস্তানে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু স্বীয় মুরব্বীর আদেশ অনুযায়ী তিনি মাদনে ইলমী তথা যেখানে শিক্ষাজীবন শুরু করেছেন সেখানেই দাওরায়ে হাদীসের স্তর শেষ করার দৃঢ় সংকল্প করলেন। তাঁর সাথে আরো ক’জন সাথীও থেকে গেলো। এভাবেই শুরু হলো জিরি মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের শিক্ষা। দাওরায়ে হাদীসের সমাপনী প্রতীক হিসেবে ছাত্রদেরকে শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব রহ. এর হাতে সম্মানসূচক পাগড়ী প্রদান করা হলো। এটাই ছিলো জিরি মাদরাসার প্রথম এবং ঐতিহাসিক দস্তারবন্দি অনুষ্ঠান।
নজীর বিহীন আনুগত্য ও বিনয় :
হযরত মুফতী সাহেব রহ. এতো কামালিয়্যাতের পরাকাষ্ঠা থাকা সত্তেও অত্যন্ত বিন¤্র ভদ্র ও বিনয়ী ছিলেন। তৎকালে হিন্দুস্থানের সফর সহজ ছিলো। তাছাড়া চট্টগ্রামে হাটহাজারীর মতো প্রাচীনতম মাদরাসাও মওজুদ ছিলো। সাধারণত প্রত্যেক ছাত্রের আগ্রহ হয়ে থাকে যে, দাওরায়ে হাদীসের কোর্সটা কোন একটা প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাপন করতে হবে। কিন্তু হযরত মুফতী সাহেব রহ. সকল আবেগ অনুভ‚তি ও উদ্যম স্বীয় ওস্তাদবৃন্দ ও মুরব্বীর ইচ্ছার সামনে জলাঞ্জলী দিলেন এবং আনুগত্য শ্রদ্ধা ও আদব আখলাকের মুর্ত প্রতীক বনে গেলেন। অবশেষে তিনি আনুগত্য ও খেদমতের এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যার নজীর যৌবনকালে কদাচিৎ পাওয়া যায়। তাঁর বিনয়ী আচরণ বারংবার এধরণের অগ্নি পরীক্ষায় পদস্থলন ঘটতে দেননি। যদি এমন কোন শিক্ষকের ভাগে তাঁর সবক পড়তো যার অভিভাষণ ছাত্ররা পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারতো না, তখন তিনি সহপাঠিদের সাথে শিক্ষক বদলানোর আন্দোলনে শরিক হতেন না, বরং এই বলেই তিনি পিছপা হয়ে পড়তেন যে, আমি কিতাব পড়ে ও বুঝে কি করবো? যদি শিক্ষকের মন জয় করতে পারি তাহলেই উপকার হবে। শিক্ষকের মনক্ষুন্ন করে কোন কাজেই স্বার্থকতা অর্জন করতে পারবো না। শরহে তাহজীব (যুক্তিবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব) সম্পর্কে আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনেছি যে, এই কিতাবটি এমন এক শিক্ষকের দায়িত্বে ছিল, যার অভিবাষণ ছাত্ররা মোটেও হৃদয়াঙ্গম করতে পারতো না, বিধায় কিতাবটি অন্য শিক্ষকের কাছে দেয়ার জন্যে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে দিল। দরখাস্ত ইত্যাদি লেখা হলো। কিন্তু তিনি ছাত্রদের সাথে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেন না। ফলে আন্দোলন ব্যর্থ হলো। উল্লেখিত কিতাব পূর্বতন শিক্ষকের কাছেই বহাল রইলো। তিনি বলেন, যে কিতাবটি শুধুমাত্র ওস্তাদের মন খুশির জন্যে পাতা উল্টিয়েছিলাম, তার বরকত এমন ভাবে প্রতিফলিত হলো যে, ভারত থেকে ফেরার পরে উল্লেখিত কিতাবটি আমার রুটিনে তালিকাভুক্ত করে দেওয়া হয়। মুরব্বিদের দোয়ায় এমন খোলা মনে পাঠদান করার তৌফিক হলো যে, উপরস্তরের ছাত্ররা পর্যন্ত তাতে অংশ গ্রহণ করতে লাগলো। এমনকি ভারতে অধ্যয়ণরত ছাত্ররা পর্যন্ত বর্ণনা করেছে যে, আমার ‘শরহে তাহজীব’ পড়ানোর সুনাম সেখানে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। দাওরায়ে হাদীসের জন্যে ভারত সফর করার ব্যপারেও তাঁর একই যুক্তি ছিলো যে, অন্যত্র গিয়ে প্রসিদ্ধ ওস্তাদের নিকট পড়ে কিইবা করবো, যদি শ্রদ্ধাভাজন দয়ালু শিক্ষকমন্ডলী ও হযরত মুহতামিম সাহেব মনে কষ্ট পেয়ে থাকেন। এই আদব ও আনুগত্যের কি প্রতিদান তিনি লাভ করেছিলেন তা জগতবাসী ভালভাবেই প্রত্যক্ষ করেছে। মরহুম আকবর এলাহাবাদী কত চমৎকারই না বলেছেন-
بزرگوں کا ادب ، اللہ کا ڈر، شرم آنکھوں میں+ انہیں اوصاف کی نسبت مذاہب میں اشارہ ہیں
অর্থাৎ- বুজুর্গানে দ্বীনের প্রতি শ্রদ্ধা, আল্লাহর ভয়ভীতি লজ্জাবোধ এই তিনটি গুণাবলীর প্রতি শরীয়তের ইঙ্গিত রয়েছে।
যে উত্তরে উস্তাদের মন প্রশান্ত হলো :
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, মুমিনদের অন্তরে শান্তি দান করা একটি ইবাদত। হযরত মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব রহ. এর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এমন কথা বললেন যদ্ধারা তাঁর অন্তর প্রশান্তি লাভ করলো। হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহ. একদা দাওরায়ে হাদীসের ছাত্রদের কে উদ্দেশ্য করে বললেন যে, তোমাদের অধিকাংশ সাথিরাতো (উচ্চ শিক্ষার জন্যে) ভারতে চলে গেছে, তাই হয়তো এখানে তোমাদের মনস্থির হচ্ছে না, তাই না? তখন তিনি অত্যন্ত গাম্ভির্যের সাথে উত্তর দিলেন যে হযরত! আমরা তো এখানে মুরব্বিদের অন্তদৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবো, যদি অন্যন্য সাথীগণ থাকতো তবে এ নেক দৃষ্টি দান বন্ঠিত হয়ে যেতো। ছাত্রের এ ধরণের উত্তরে তিনি খুবই খুশি হলেন এবং একনিষ্ঠ ভাবে দোয়া করলেন। তাঁর এ সারগর্ভ জবাবে একদিকে যেমন একজন মুমিনের আত্মা শান্তি পেলো, তেমনি অপর দিকে শ্রদ্ধেয় ওস্তাদের সুদৃষ্টি আরো বৃদ্ধি পেলো।
উচ্চ শিক্ষার্থে ভারত গমন :
نگہ شوق میں ہیں اور بھی صدہا عالم+ یہ نہ سمجھو کہ یہیں تک نمایاں ہے کوئی
আকাংখা ও বাসনার দৃষ্টিতে আরো শত সহ¯্র জগত বিদ্যমান। তাই মনে করো না যে, এই পর্যন্তই শেষ গন্তব্য। একজন সত্যিকার ছাত্র ইলম অর্জনের পথে কোনো স্তর অতিক্রম করে ক্ষান্ত হয়না, বরং আরো আগে বাড়ার বাসনা জাগে তার হৃদয়পটে। সর্বদা সোচ্চার কন্ঠে সে বলতে থাকে رب زدني علما প্রভ‚ আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও। এভাবে বেহেশতে প্রবেশ করে হাউজে কাউসার ও তাসনিম পানপাত্র হাতে আসা পর্যন্ত তার এ তৃষ্ণা নিভৃত হবার নয়। নবী করীম স. যথার্থই বলেছেন:
لن يشبع المؤمن من خير يسمعه حتى يكون منتهاه الجنة
অর্থাৎ- মুমিন জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত ইলম শিখে পরিতৃপ্ত হতে পারে না। দেশে প্রচলিত দরসে নিজামীর শিক্ষা সমাপ্ত করার পর অধিকতর উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ভারত গমনের প্রবল ইচ্ছা জাগল তাঁ হৃদয়পটে। শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সহ উস্তাদগণের এটাই ইচ্ছা ছিলো যে, তাঁকে ভারতের শীর্ষস্থানীয় ওলামাদের জ্ঞানসমুদ্র থেকে জ্ঞানাহরণের মাধ্যমে জ্ঞানপিপাসা নিবারণ এবং সেখানকার মাশায়েখগণের নিকট থেকে ফয়েজ লাভ করার সুযোগ করে দেওয়া হোক। তাই সম্মানিত উস্তাদগণের উৎসাহ প্রদানের ফলে তাঁর সুপ্ত আকাংখার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলো এবং মনে অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হলো।ছোট্ট বেলায় পিতৃবিয়োগের কারণে তিনি উত্তরাধিকারমূলক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন বিধায় পাথেয় জোগাড় করা ছিলো তাঁর জন্যে খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু মর্দে মুমিনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সামনে অভাব অনটন অন্তরায় হতে পারে না। আর না পারে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ ও দুর্গম গিরিপথ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে, বরং কন্টকময় রাস্তার বক্ষ বিদীর্ণ করে অগ্রযাত্রা সে অব্যহত রাখে। বাহ্যত তাঁর জন্যে এমতাবস্থায় এতো দূর দেশের সফর ও কয়েক বছরের খরচ যোগাড় করা কঠিন ব্যাপার ছিলো। কিন্তু অবশেষে সকল সমস্যা দূর হয়ে গেলো। ইকবাল মরহুম কত চমৎকারইনা বলেছেন-
جرأت ہو نمو کی تو فضا تنگ نہیں ہے+ اے مرد خدا ملک خدا تنگ نہیں ہے
অর্থাৎ- অগ্রযাত্রার সাহস থাকলে ক্ষেত্রের অভাব হয় না। হে আল্লাহর পথের পথিক! আল্লাহর রাজ্য সংকীর্ণ নয়। (ইকবাল)
সহায় সম্বলহীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা :
একদিকে বাহ্যত রাস্তার সম্বল যোগাড় করার কোনোই ব্যবস্থাই নেই। অন্যদিকে স্বীয় অভাব অনটনের কথা কারো কাছে প্রকাশ করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। কোন কিছু চাওয়া বা আকাংখা করা তো দূরের কথা এর বাস গন্ধ থেকেও তিনি সরে থাকতে লাগলেন। এমন কি নিজের আত্মিয়-স্বজনের সাথে বিদায়ী সাক্ষাত করতে সঙ্কোচবোধ করতে লাগলেন। আত্মীয়রা পাথেয়র প্রয়োজনে দেখা করতে এসেছেন বলে মনে করবেন এ ভয়ে। কবির ভাষায়-
نظر اللہ پہ رکھتا ہے مسلمان غیور+ موت کیا شیٔ ہے فقط عالم معنی کا سفر
অর্থাৎ- আত্মমার্যাদাবোধ সম্পন্ন মুসলমান একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা রাখে আর মৃত্যু তো ভাব জগতের সফর ছাড়া আর কিছুই নয়। (ইকবাল)
তাঁর দাদা জনাব মুনশী সুরত আলী সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে, খরচের কি ব্যবস্থা হবে? আমি কি কোন বিষয় সম্পত্তি বিক্রয় করব? তিনি রাজি হলেন না। অবশেষে পাথেয় সংগ্রহ ছাড়াই আল্লাহর উপর ভরসা করে শাওয়াল মাসের পাঁচ তারিখ দিনক্ষণ নির্ধারণ করলেন। যখন সফরের তারিখ একেবারে ঘনিয়ে এলো দাদা সাহেব বারবার জিজ্ঞাসা করলেন যে, সময় তো একেবারে ঘানিয়ে এসেছে, তুমি কিছু বলছোনা যে, তিনি বললেন যে, চেষ্টা আমার কাজ আর সেই চেষ্টাকে ফলপ্রসু করা আল্লাহ তাআলার কুদরতের কব্জায়। তাই নির্দিষ্ট তারিখে চট্টগ্রামের রেলস্টেশন পর্যন্ত যাব। আল্লাহ তাআলা আসবাবপত্র ও পাথেয় যোগাড় কওে দিলে ভাল না হয় ফিরে আসবো। নির্দিষ্ট তারিখে তিনি স্টেশনে পৌছে গেলেন এবং বহু আত্মীয় স্বজন উপস্থিত হলেন, তখনো পাথেয়ের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাঁর চেহারায়ও কোন উদ্বেগ উৎকন্ঠার চাপ পরিলক্ষিত হয় নি। হঠাৎ তাঁর শ্রদ্ধেয় চাচা মুনশী নুরুন্নবী ট্রেনের একটি টিকেট নিয়ে হাজির হলেন এবং নগৎ কিছু টাকাও তাঁর হাতে দিলেন। তাঁকে বিদায় জানাবার জন্যে মাদরাসার শিক্ষক ছাত্র ও বন্ধু বান্ধবদের সাথে শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেবও তাশরীফ আনলেন। তাঁর প্রিয় ভাই মরহুম মাস্টার আহমদুল হক সাহেবের বর্ণনা মতে হযরত শাইখুল হাদীস অশ্রæসিক্ত নয়নে মোনাজাত করেছিলেন। এই দৃশ্য অবলোকনে স্টেশনে উপস্থিত মুসলমানেরাও বিস্মিত হয়ে শরীক হলেন, তিনি অন্তরে দুনিয়াসমান আকাংখা ধারণ করে মুরব্বিগণের দোয়া অন্তদৃষ্টি কে পুঁজি করে মাতৃভ‚মি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং ওস্তাদবৃন্দকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে যাত্রা আরম্ভ করলেন। কবির ভাষায়:
اک قدم جانا جنہیں دشوار تھا+ شوق لیکر سینکڑوں منزل گیا
অর্থাৎ- এক পা অগ্রসর হওয়া যার জন্যে কষ্টকর ছিলো অদম্য উচ্ছাস তাকে আজ শত সহ¯্র মাইল নিয়ে গেল।
ভারত সফরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য :
ভারত সফরে রওয়ানা হওয়ার মুহুর্তে হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহ. দোয়ার মধ্যে যে সকল শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন সেগুলো তাঁর সফরের লক্ষ সম্পর্কে ইঙ্গিতবহ ছিল। তিনি ¯েœহ মায়া ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে এই দরখাস্তই পেশ করেন: হে আল্লাহ আমি আমার প্রিয় পাত্রকে আপনার হাতে তুলে দিলাম। আপনি তাকে কবুল করে নিন। হে জগৎ অধিপতি, আমি আমার প্রিয় পাত্রকে আপনার প্রিয় বান্দাদের খেদমতে পাঠাচ্ছি, আপনি তাকে ঐ সমস্ত বুজুর্গানে দ্বীনের সান্নিধ্য এবং বরকত নসীব করুন। এসব বেদনা বিধুর প্রার্থনা সম্বলিত শব্দ উচ্চারণ করেই তাঁকে বিদায় দিলেন। তখন মনে হচ্ছিল তিনি যেন শেখ সাদি রহ. এর ভাষায় বলেছেন-
دیدۂ سعدی و دل ہمراہ تست+ تانہ پنداری کہ تنہا می روی
অর্থাৎ- দূর পথের অভিযাত্রি! তুমি এ কথা ধারণা করনা যে, তুমি একাই চলছ; বরং তোমার সাথে সাদীর চক্ষু ও অন্তরও রয়েছে।
হিন্দুস্থানে পৌছার পর তিনি সর্বপ্রথম দারুল উলুম দেওবন্দে গিয়ে উপস্থিত হলেন, ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান লাভ করলেন। থাকা খাওয়ারও ব্যবস্থা হয়ে গেলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে তাঁর স্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছিল না। তাই তিনি সাহারানপুর চলে গেলেন। সাহারানপুর মাদরাসায় ভর্তির দায়িত্ব ছিল হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান কামিলপুরি রহ. এর হাতে। প্রশ্নমালা সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করায় তাঁর জ্ঞান ও সাহিত্য যোগ্যাতা সম্পর্কে পরীক্ষকের ধারণা হয়ে গেল। মরহুম মাওলানা শাহ আব্দুল মজিদ সাহেব মাদারশাহী রহ. তিনি চট্টগ্রামের প্রাচীন যুগীয় বুযুর্গদের আদর্শ এবং হযরত মুফতী সাহেবের ভগ্নিপতী ছিলেন। পবিত্র হজ্জ্ব শেষে ভারতে অবতরণ করতঃ তাঁর সাথে সাক্ষাত করে আসেন। এ সময় তিনি সাহারানপুর মাদরাসার শিক্ষক মহোদয়গণের কাছে জানতে পারলেন যে, পরীক্ষক সাহেব তাঁর সফরের লক্ষ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেন, আমি আপনাদের খেদমত করার জন্যে এসেছি। তাঁর একান্ত শ্রদ্ধাভাজন ওস্তাদ যাত্রাকালে যে লক্ষ্যের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন, সেই পাঠটি তাঁর খুবই স্মরণ ছিলো। তাই তো পরীক্ষক মহোদয়ের প্রশ্নের সাথে সাথে সেই কথাটি মুখ থেকে নিঃসৃত হলো। তদুপরি এই কথাটি তাঁর বিনয়ী আচরণের ও অনুকুল ছিলো। তিনি যেন এই কথাই বলতে চেয়েছিলেন, এই মহান ব্যক্তিবর্গের নিকট শিক্ষালাভের জন্যে তার কিইবা যোগ্যতা আছে; বরং যদি কিছুদিন তাদের সাহচর্যে থেকে খিদমত করার সুযোগ মিলে যায়, তবে এটাই হবে তার পরম পাওয়া। আশ্চর্য আত্মবিনয়! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তিনি তাঁদের চরণে পৌঁছতে পেরে যেন ইকবালের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে একথাই বলেছিলেন:
مانا کہ تری دید کے قابل نہیں ہوں میں +تو میرا شوق دیکھ، میرا انتظار دیکھ
অর্থ: আমি জানি তোমার দর্শন লাভের যোগ্য আমি নই। তবে তুমি আমার হৃদয়োচ্ছাস ও সুদীর্ঘ অপেক্ষাই প্রত্যক্ষ করো। (ইকবাল)
ভারতের প্রখ্যাত ওলামা মাশায়েখের কাছে জ্ঞানাহরণ :
তিনি ভারতে ইলম ও মারেফাতের চারটি কেন্দ্র থেকে জ্ঞানর্জন করেন। (১) সাহারানপুর মাজাহেরুল উলু মাদরাসা (২) দারুল উলুম দেওবন্দ (৩) হযরত মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. (৪) হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবভী রহ.। স্থুল দৃষ্টিতে আমার এ ধরণের বর্ণনা বিতর্ক ও প্রশ্নের সম্মুখিন হতে পারে। কেননা এখানে তো দুটি মাদরাসা ও দুজন ব্যক্তিত্তের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যাই হোক এটাই বাস্তব। আমি হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. কে কোনো মাদরাসার অংশ বিশেষ বলতে চাই না, কারণ তিনি নিজেই একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ মাদরাসা ও জীবন্ত পাঠাগার ছিলেন। যা মাটির বুকে চলাফেরা করতো। আর হাক্বীমুল উম্মাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর ব্যক্তিত্বও ছিলো একটি আধ্যাত্মিক মাদরাসা বা আত্মশুদ্ধির কেন্দ্র। তাঁর খানাকায়ে ইমদাদিয়াকে আত্মশুদ্ধির একটি বিশ্ববিদ্যালয় বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ জন্যেই আমি বলেছি যে, হযরত মুফতী সাহেব রহ. এ বরকতময় সফরে এ বিশেষ ৪ টি কেন্দ্র থেকে ষোল কলায় শরীয়ত ও তরীক্বতের জ্ঞানর্জন করেন।
সাহারানপুর মাদরাসায় অবস্থান :
মাদরাসা মাজাহেরুল উলুম সাহারানপুরে তিনি মাদরাসার সাবেক প্রধান শিক্ষক হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান কামেলপুরির কাছে সর্বাধিক জ্ঞানর্জন করেন। ক্লাসের সময় ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে তিনি সঙ্গিদের সাথে মাওলানার কাছে লেখা শিখতেন। এতে তাঁর উপর মাওলানার অন্তদৃষ্টি গভীর ভাবে পড়তে থাকলো। রচনা খাতায় তিনি নাম্বার দিয়ে দিতেন যাতে ছাত্রদের মধ্যে প্রতিযোগিতার স্পৃহা সৃষ্টি হয়। এতে গযরত মুফতী সাহেব রহ. সর্বাধিক নম্বও পেতেন।আল-জামেয়া পটিয়ার সাবেক উপধক্ষ্য ও হযরত মাওলানা জমীরুদ্দিন সাহেব রহ. এর বিশেষ খলীফা হযরত মাওলানা উবাইদুর রহমান মাদরিশাহী রহ. (মৃত্যু ১৪০৪ হি.) যিনি হিন্দুস্থানে হযরত মুফতী সাহেবের সফরসঙ্গি ছিলেন। বলেন যে, গংগুহ এলাকার একজন ছাত্র হযরত মাওলানা কামেলপুরি রহ. এর কাছে অভিযোগ করল যে, হযরত, আপনি কেন চট্টগ্রামের আযীযুল হককে প্রায়শ অধিক নম্বর দিয়ে থাকেন? মাওলানা উত্তরে বললেন যে, তুমিই তার লেখার বিষয়বস্তু দেখ এবং প্রাপ্য নাম্বার দাও। উক্ত ছাত্রের সম্মুখে হযরত মুফতী সাহেবের খাতাটি পেশ করে দিলেন। ছাত্রটি তাঁর চমৎকার গ্রন্থনাশৈলী আলংকরিক নৈপূণ্য ও নান্দনিক বৈশিষ্ট দেখে নিজের কৃত অভিযোগে লজ্জিত হলো এবং তাঁর যোগ্যতা ও সর্বোচ্চ নাম্বারের অধীকারী হওয়া অকপটে স্বীকার করে নিলো।
সুন্দর উত্তরের কারণে পরীক্ষায় নকল করার সন্দেহ :
সাহারানপুর মাদরাসায় একবার কাজি মোবারক (যুক্তিবিদ্যার একটি জটিল কিতাব) এর পরীক্ষায় হযরত মুফতী সাহেবের সুন্দর উত্তর ও বর্ণনাশৈলী দেখে পরীক্ষক সন্দেহ পোষণ করলেন যে, ছাত্রটি হয়তো কোনো টিকা গ্রন্থ দেখে হুবহু নকল করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন কিতাবের টিকা ও প্রান্তটিকার সাথে মিলিয়ে কোথাও হুবহু এ এবারত পাওয়া যায়নি। তবুও পরীক্ষক সাহেব মাওলানা কামেলপুরী রহ. (যার সাথে হযরত মুফতী সাহেবের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিলো) এর কাছে তাঁর এ সন্দেহ প্রকাশ করলেন। হযরত কামেলপুরী রহ. উত্তরে বললেন যে, এটা কখনো নকল হতে পারে না। এ ছাত্রের যোগ্যতা সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। যেহেতু তাঁর ভর্তি পরীক্ষা আমার কাছে ছিলো। সে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। এ ঘটনাটার পর সমস্ত ওস্তাদগণের দৃষ্টিতে তাঁর ব্যক্তিত্ব বেড়ে গেলো এবং পুরো মাদরাসায় কৃতিছাত্র হিসেবে খ্যাত হয়ে গেলেন।
দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষা গ্রহণ :
মাদরাসা মাজাহের উলুম সাহারানপুরে তাঁর ভর্তি ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা অতি সহজেই সমাধা হয়েছিল। এক বৎসর মাকুলাতের (তর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা) শিক্ষালাভের পর দেওবন্দের ওলামা-মাশায়েখের নিকট থেকে ফয়েজ লাভের প্রবল ইচ্ছা তাঁকে অস্থির করে দিল। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি সর্বপ্রথম দারুল উলুম দেওবন্দে হাযির হয়েছিলেন এবং ভর্তি সম্পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতা ও আবহাওয়া অনুক‚ল না হওয়ার কারণে সাহারানপুর চলে এসেছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দের যে স্বাদ তিনি পেয়েছিলেন তা তাঁর অনুভ‚তিকে আবারো আন্দোলিত করলো। হিন্দুস্থানের মাটিতে পা রেখে উপমহাদেশের অহংকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহান ঝর্ণা ধারা থেকে তৃষ্ণা নিবারণ ব্যতীত স্বস্তি আসছিলনা।
وعدۂ وصل چوں شود نزدیک+ آتش عشق تیز تر گردد
অর্থাৎ- মিলন মুহুর্ত যখন ঘনিয়ে আসে, তখন প্রেমের আগুন অধিকতর তেজ হয়ে যায়।
এ জন্য পরবর্তী বৎসর দারুল উলুম দেওবন্দে পুনঃবার ভর্তি হলেন। এবারও সেখানে স্বাস্থ্যগত কারণে টিকতে পারেন নি। অতিকষ্টে কয়েকমাস অবস্থান করতঃ দাওরায়ে হাদীসের পাঠে বসে সেখানকার প্রথম শ্রেণীর ওস্তাদগণের শাগরিদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তবে দারুল উলুম দেওবন্দের বরকতময় পরিবেশ ও মাশায়েখের সাহচর্য লাভে ধন্য হওয়ার যতটুকু আকাংক্সক্ষা ছিল, তা পূর্ণ হলো না। কবির ভাষায়-
ما كل ما يتمنى المرء يدركه- تجرى الرياح بما لاتشتهى السفن
অর্থাৎ- মানুষের সব ইচ্ছা পূরণ হয় না। যেমন বাতাস সবসময় নৌকা সাম্পাদনের অনূক‚লে বহে না। আকবর এলাহাবাদী কতই না সুন্দর বলেছেন-
چلتی نہیں کچھ اپنی، کوئی ہزار چاہے+ ہوتا ہے بس وہی جو پروردگار چاہے
অর্থাৎ- কেউ হাজারবার চাইলেও কোন কিছুই হবার নয়। তা-ই হয় যা পরওয়ারদেগার চান।
কিন্তু তিনি বৎসরের মধ্যভাগে দেশে ফিরে আসার স্থলে আত্মশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির স্তরসমূহ অতিক্রম করার মহান ব্রত নিয়ে থানাভনে চলে গেলেন। কেননা তাঁর জানা ছিলো যে, বাহ্যিক জ্ঞান আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ ব্যতীত অসম্পূর্ণ এবং ইলমে বাতিনের এ মঞ্জিলের সামনে আরো বহু মঞ্জিল রয়েছে। যেমন আল্লামা ইকবালের ভাষায়-
علم کی حد سے پرے بندۂ مؤمن کیلئے+ لذت شوق بھی ہے ، نعمت دیدار بھی ہے
অর্থাৎ- ইলমের সীমা পেরিয়ে মুমিনের জন্যে আত্মার আস্বাদন ও দর্শন লাভের মতো নিয়ামত নিহিত রয়েছে।
হযরত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.-এর সান্নিধ্যে গমন :
দারুল উলুম দেওবন্দের সমকালিন ওস্তাদগণের মধ্যে হযরত মুফতী সাহেবের উপর হযরত শাহ সাহেবের প্রভাব বেশি পড়েছিলো। হযরত শাহ সাহেবের ব্যক্তিত্বকে তিনি অসাধারণ প্রতিভা ও ইসলামের মুজিযা (অলৌকিক শক্তি) গণ্য করতেন। তিনি বলতেন, হিন্দুস্থানে গমনের পর সেখানকার বরেণ্য ওলামা-মাশায়েখের শিষ্যত্ব লাভ করার সুযোগ যখন হলো, তখন সকলের সম্পর্কে ধারণা জন্মেছিলো মানুষ চেষ্টা সাধনা করলে এ ধরণের যোগ্যতা ও কামালিয়্যাত লাভ করতে পারে। তবে হযরত শাহ সাহেব রহ. ছিলেন ব্যতিক্রম। কেননা, সাধনা করে সাধারণত এতো জ্ঞান আয়ত্ব করা সাধ্যাতীত ব্যাপার। ইলম ও মারেফাতের এ বিশাল সমুদ্র দেখাও বড় সৌভাগ্যেও ব্যাপার। এর দ্বারা অনুমান হয়ে যায় যে, একবিন্দু পানির কিইবা অস্থিত্ব থাকতে পারেএই বিশাল সমুদ্রের সামনে। সমুদ্রের এই প্রশস্ততা দেখে যে বিন্দু অবাক বিস্ময়ে বলে, আমার কতটুকুই বা গভীরতা? কতইবা আমার দৈর্ঘ্য প্রস্থ? কিইবা আমার পুঁজি? কুল কিনারাহীন এই অথৈ সমুদ্রের সামনে আমার অস্থিত্ব তো একেবারেই নগন্য। এধরনের তুলনামূলক অধ্যবসায় অনেক সময় সফলতার দর্জা খুলে দেয়। হযরত শাহ সাহেবকে জানার জন্যে তাঁর শাদরিদগণকে দেখাই যথেষ্ট। عن المرء لا تسئل وسل عن قرينه- فكل قرين بالمقارن يقتدي
অর্থাৎ- কাউকে জানার জন্যে তাঁর সম্পর্কে প্রশ্ন করো না। তাঁর সহচর সম্পর্কে প্রশ্ন করো। কারণ প্রত্যেক বন্ধু ও সহচর একে অপরের অনুসরণ করতে থাকে।
হযরত মাওলানা বদরে আলম মিরাঠ মুহাজেরে মাদানী রহ. এবং প্রখ্যাত হাদীশ বিশারদ আল্লামা সাইয়েদ মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী রহ. এর মতো উঁচু মানের ওলামায়ে কেরাম পর্যন্ত তাঁর ছাত্র হওয়ার কারণে গর্ব করতেন। সুতরাং হযরত শাহ সাহেবের ব্যপারে কি মন্তব্য করা যেতে পারে? হযরত বিন্নুরী সাহেব রহ. ভাষণ ও অভিভাষণ দান করলে যদি হযরত শাহ সাহেবের নাম এসে যেত তখন তিনি আবেগ উচ্ছাসে দিশেহারা হয়ে বলতেন, শাহ সাহেবের ব্যক্তিত্ব কি ছিলো, তিনি ছিলেন ইলমের এক পাহাড় ও ক‚ল কিনারাহীন মহাসমুদ্র। একবার হযরত বানুরী রহ. পটিয়া তাশরীফ আনেন এবং মাদরাসার মসজিদে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন, এতে প্রসঙ্গক্রমে হযরত হযরত শাহ সাহেŸ রহ. এর নাম এসে গেলে তিনি বলেন যদি কোন মুর্খ ব্যক্তি কোন আলেমের ইলম অনুমান করতে সক্ষম হয় তাহলে আমি অধম মুর্খই হযরত শাহ সাহেবের জ্ঞানের কিছুটা অনুমান করতে পেরেছি। মোট কথা হযরত মুফতী সাহেব রহ. হযরত শাহ সাহেব রহ. এর ইলম ও মারেফাতের সম্পর্কে লাভ এবং সে শীতল সুপের ঝর্ণা থেকে যথাসম্ভব তৃষ্ণা নিবারণ করেন।
হাকীমুল উম্মাত হযরত থানভী রহ.-এর দরবারে :
کام نکلے گا نہ اے دوست کتب خانوں سے+ رہنے کچھ روز کس محرم اسرار کے ساتھ (اکبر)
অর্থাৎ- শত সহ¯্র পাঠাগারের কিতাবাদি পাঠ করেও অধ্যবসায়ে নিমগ্ন থেকে কোন কাজ হবে না। বন্ধু! আল্লাহর রহস্য জ্ঞানে অভিজ্ঞদের পাশে গিয়ে কিছুদিন অবস্থান করো। (আকবর এলাহাবাদী)
হযরত মুফতী সাহেব রহ. অসুস্থতার কারণে বছরের মধ্যবর্তী সময়ে লেখা পড়া ছেড়ে দিয়ে দেওবন্দ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কে জানতো তাঁর অপারগতা ও অক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে তাঁর লক্ষ্য জ্ঞান, প্রজ্ঞাকে বাস্তবে রুপায়ন এবং জ্ঞানকে তাত্বিক পর্যায় থেকে ব্যবহারিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো। কোন কোন ব্যর্থতা ও প্রতিবন্ধকতা বিজয়, সফলতা ও অগ্রগতির সোপান হয়ে থাকে। কোন কোন নিরব নিস্তব্দতা ও গুমোট আবহাওয়া ঝড় ঝঞ্জার পূর্বাভাস হয়ে থাকে। জ্ঞানান্বেষণের ময়দানে যে, ক্ষিপ্ত গতিতে যাওয়ার বাসনা ছিলো হঠাৎ তাতে সামান্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলো বিধায় তিনি মনে মনে ভীষণ দুঃখ ও ব্যথা বহন করে চললেন এবং চিন্তা করলেন কিছুদিন কোন বুযুর্গের সাহচর্যে থাকা উচিৎ। তাদের জুতো সোজা করা ব্যতীত ইলম তথা জ্ঞান-পরীমা তো আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের পথে এক বিরাট অন্তরায় হয়ে থাকবে।
چوں کسب علم کردی در عمل کوش+ کہ علم بے عمل زہریست بے توش
অর্থাৎ- “ইলম যখন অর্জন করেছো আমল করার চেষ্টা করো। কেননা আমল বিহীন এলম অপেয় বিষতুল্য।” (জামী)
নিষ্ঠাপূর্ণ আমলের যোগ্যতা অর্জন ছাড়া ইলম বিষ সমতুল্য এ বিষের প্রতিষেধক একমাত্র আল্লাহ প্রেমিকদের আস্থানায় পাওয়া যায়।
تمنا درد دل کی ہے تو کر خدمت فقیروں کی+ نہیں ملتا یہ گوہر بادشاہوں کے خزینے میں
অর্থাৎ- “ব্যথিত হৃদয়ের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে খোদা পাগল দরবেশদের খেদমত করো।” কারণ, এ অমূল্য রত্ম রাজা বাদশাদের দরবারে পাওয়া যায় না।
হযরত মুফতী সাহেব রহ. পূর্ব থেকেই হযরত হাকীমুল উম্মতের ভক্তি শ্রদ্ধায় বিভোর ছিলেন বিধায় এ সুযোগকে সদ্ব্যবহার করে তিনি থানাভনে গিয়ে উপস্থিত হলেন। হযরত হাকীমুল উম্মাতের দরবারে আগ্রহ ব্যক্ত করার সাথে সাথে বাইয়াত করার প্রথা ছিলো না; বরং বাইয়াতকে যে আসল উদ্দেশ্য মনে করে করা হতো তা খতম করে দিতেন। যেমন তিরি ইরশাদ করেন, “ বাইয়াতের মূল হচ্ছে দুইটি জিনিস আবশ্যকীয় করণ। একটি মুরীদের জন্যে, অপরটি পীরের জন্যে। মুরীদ পীরের অনুসরণকে এবং পীর মুরীদের আত্মশুদ্ধিকে বাধ্যতামূলক ও অত্যবশ্যকরণীয় হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু এর জন্যে বাইয়াতের প্রচলিত নিয়মকে অত্যবশকীয় মনে করা বিদআত। এর মুলোৎপাটন অপরিহার্য। (ফুয়ুজুল খালেক, ৮ম খন্ড ১৭ পৃ.) হযরত থানভী রহ. অপর এক মজলিসে বলেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ কোন বুযুর্গের সাহচর্যে থেকে দুটো গুণের অধীকারী হওয়া। এর পওে ইসলামের যে কোন খেদমত করবে তা পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
প্রথমত অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বাত সৃষ্টি করা, আর দ্বিতীয়ত অন্তরে আল্লাহর ভয়-ভীতি সৃষ্টি করা। এ দুটি গুণের সমন্বয় ঘটলেই আমলে পরিপূর্ণতা আসবে। (মালফুজাত) উপরে বর্ণিত মোট কথা , হযরত মুফতী সাহেব রহ. হযরত থানভী রহ. এর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ছয় মাস পর্যন্ত বিনা বাইয়াতে ইসলাহ লাভ করতে থাকেন। প্রদর্শিত নিয়মানুযায়ী যিক্র আযকার এবং রিয়াজাত মুজাহাদা বা আধাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। আমার শ্রদ্ধাভাজন ওস্তাদ হযরত মাওলানা ওবাইদুর রহমান সাহেব রহ. (সাবেক নায়েবে মুহতমিম মাদরাসা জমিরিয়া পটিয়া) বলেন যে, আমি ঐ সময় হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর সাথে হযরত থানভী রহ. এর সান্নিধ্যে থেকে আত্মশুদ্ধি লাভ করেছিলাম। খানকায়ে এমদাদিয়াতে আমাদের উভয়ের প্রত্যাহিক মামুলাত ও অজিফা নি¤œরুপ ছিলো।
১. বার তাসবিহর যিকর আদায়।
২. ইসমে জাতের যিকর ৪৮ হাজার বার। (ইসমে জাত লফজ আল্লাহ কে বলা হয়।)
৩. কুরআন শরীফ তেলাওয়াত দু’পারা।
৪. মুনাজাতে মাকবুল এক মনজিল।
এভাবে রাত দিন হযরত থানভীর মজলিস মালফুজাত (আধ্যাত্মিক বাণী সমূহ) ও সাহচর্যের মাধ্যমে দীক্ষাগ্রহণ এবং স্বীয় মামুলাত ও ওজায়েফে ব্যস্ত থাকায়ই ছিলো আমাদের প্রত্যাহিক কাজ।
হযরত মুফতী সাহেব রহ. দেশে প্রত্যবর্তন করেও চিঠিপত্রের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করতে থাকলেন। এবং হযরত থানভী রহ. এর প্রদর্শিত নিয়মানুসারে তরিকতের কাজ করতে থাকেন। অবশেষে শায়খুল মাশোয়েখ হযরত মাওলানা জমীরুদ্দিন সাহেব রহ. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।
ভারত থেকে প্রত্যাগমন এবং শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ :
১৩৪৫ হিজরীর শেষের দিকে মরহুম মুফতী সাহেব যখন ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিলো প্রায় বিশ বছর। এ দিকে জিরি মাদরাসার দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ যাদের তিনি নয়নমণি ছিলেন এবং তাঁর বিচ্ছেদে যারা দীর্ঘ দিন যাবৎ অশ্রæশিক্ত ছিলেন, তারাও তাঁর প্রত্যাবর্তনের জন্যে প্রহর গুনছিলেন। তাই স্বদেশের মাটিতে পা রাখতেই তাঁকে জিরি মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থির হয়ে গেলো। সম্ভবত ১৩৪৫ হিজরির শাবান পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩/ ১৪ বছর সেই ধর্মীয় বিদ্যানিকুঞ্জে তিনি শিক্ষকতা ও ফতওয়া দানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। যেখানে তিনি জ্ঞানের চক্ষু উম্মিলিত করেছিলেন। একই সাথে মাদরাসার শিক্ষাপরিচালনা বিভাগের দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত ছিলো। তাঁর পাঠদান এতই উপকারী এবং গ্রহনযোগ্য হলো যে, ছাত্ররা তাঁর কাছে পড়ার জন্যে প্রবল আগ্রহ করতে লাগলো। প্রথম থেকে শরহে তাহজিব পাঠদানের এতই সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো যে, ভারতে অধ্যয়নরত বাঙ্গালী ছাত্রদের হৃদয়ে তাঁর পাঠে অংশ গ্রহণের দারুণ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এমনকি জিরি মাদরাসার উপরের শ্রেণির ছাত্ররাও তাঁর পাঠে অংশ গ্রহণ করতে লাগলো। এভাবে যে কোন কিতাব ছাত্ররা মরহুম মুফতী সাহেবের কাছে পড়তো, তা অন্য কোন শিক্ষকের কাছে পড়ে তৃপ্তি পেতো না।
পাঠদান পদ্ধতি:
ছাত্রদের মাঝে মুফতী সাহেব রহ. এর পাঠদানপদ্ধতি খুবই সমাদৃত হয়েছিলো। তাঁর পাঠদান শুধুমাত্র জিরি মাদরাসা নয়; বরং সকল মাদরাসায় শিক্ষকদের জন্যেও একটি স্বার্থক আদর্শে পরিণত হয়েছিলো। তিনি এবারত (রীডিং) ও শাব্দিক তর্জমা পড়ানোর প্রবক্তা ছিলেন না। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, তিনি কিতাব সামনে নিয়ে বিষয় ভিত্তিক পাঠদান করতেন, যার ফলে সর্বস্তরের ছাত্ররা উপকৃত হতে পারতো না। প্রাচীনকালে বিষয়ের জন্যে কিতাব পড়ানোর প্রথা ছিলো। কিন্তু সমসাময়িক শিক্ষাবিদগণ মনে করেন যে, কিতাবের জন্যেই কিতাব পড়ানো চাই। হযরত মুফতী সাহেব রহ. ও এ মত পোষণ করতেন। কিন্তু তাঁর পদ্ধতী ছিলো : পাঠের সারকথা অত্যন্ত সহজ ভাবে উপস্থাপন করা । এরপর ছাত্রদের কাজ বাকি থাকতো শুধু এই সংক্ষিপ্ত কথাকে বিস্তারিত আলোচনার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া।
আমাদের ওস্তাদ হযরত মাওলানা আমির হোসাইন সাহেব রহ. ওরফে মীর সাহেব (মৃত্যু ১৪০৪ হিঃ) বলতেন , হযরত মুফতী সাহেব পাঠ তৈরির জন্যে খুবই পরিশ্রম করতেন। সংশ্লিষ্ট পাঠের গভীরে গিয়ে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করে মূল বক্তব্য অনুধাবনের পর তা সাজিয়ে গুাছিয়ে হৃদয়ঙ্গম করে শ্রেণিকক্ষে যেতেন; বরং তিনি আগে থেকেই চিন্তা করে রাখতেন যে, কিভাবে সহজ থেকে সহজতর পন্থায় ছাত্রদের সামনে মূল বক্তব্যকে উপস্থাপন করা যায়। এ কারণে তাঁর পাঠের বক্তব্য ছিলো খুবই মুন্সিয়ানাপূর্ণ বিশ্লেষণধর্মি সুবিন্যস্ত ও হৃদয়গ্রাহী। তাঁর বাচনভঙ্গি ছিলো অত্যন্ত নিখুঁত এবং চিত্তাকর্ষক। কঠিন থেকে কঠি ন স্থানগুলোও অতি সহজে বুঝে এসে যেতো। এছাড়া তিনি খুবই লম্বা চওড়া বিষয়কে অতি সংক্ষিপ্ত কথায় ছাত্রদেরকে হৃদয়ঙ্গম করে দিতে পারতেন।
এ যুগের যেসব অভিজ্ঞ আলেম হযরত মুফতী সাহেবের পাঠ গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন (যাদের মধ্যে গ্রন্থকারের বহুসংখ্যক শিক্ষকও রয়েছেন) তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা তাকে অন্যকে বুঝানোর যে যোগ্যতা দান করেছেন, তার ফলে মানতেক (যুক্তিবিদ্যা) এর মতো কঠিন বিষয়ও অত্যন্ত মামূলি মনে হতো।
জিরি মাদ্রসায় শরহে তাহজিব, মোল্লা হাসান, তাফসীরে জালালাইন এবং মুসলিম শরীফ প্রভৃতি কিতাব সমূহের পাঠ প্রায়শই তাঁর দায়িত্বে থাকতো। পটিয়া মাদরাসায় একবার তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, আজকাল আমি না শিক্ষার্থীদের উপর সন্তুষ্ট হতে পারছি, আর না শিক্ষকের উপর। হযরত মীর সাহেব রহ. ও হযরত মাওলানা ইসহাক গাজী সাহেব রহ. প্রমুখের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন যে, আমি যখন পাঠদান দিয়েছি তখন কিভাবে দিয়েছি, এদেও থেকে জিজ্ঞেস করো। হাটহাজারি মাদরাসার তাফসীর বিভাগের প্রধান হযরত মাওলানা আবুল হাসান রহ. একদা বলেন, যুক্তিবিদ্যার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব “হামদুল্লাহ” এর গুরুত্বপূর্ণ পাঠ وجود رابطی এবং صدرا এর جزء لا یتجزیٰ পাঠটি আমার বোধগম্য হচ্ছিলো না। বড় বড় দক্ষ শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করেও মনের তৃপ্তি লাভ করতে পারিনি। হযরত মুফতী আযীয সাহেব রহ. এর কাছে পেশ করলে তিনি কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে সমাধান দিয়েছিলেন। মাওলানা আবুল হাসান আরো বলেন, হযরত মুফতী সাহেব রহ. কে আমি বড় মাপের বুজুর্গ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী মনে করতাম। কিন্তু তিনি যে, ইলমে জাহেরী ও বাতেনীর মধ্যে এরকম দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রাখেন তা এখন বুঝতে পারলাম। তিনি যুগের সুফি সাধকদের মধ্যে বিশেষ মার্যাদার অধিকারী ছিলেন। (বর্ণনা: হযরত নানুপুরী সাহেব রহ.)
অধ্যয়নে মনোযোগ:
ঘযরম মুফতী সাহেব রহ. অধ্যয়নে এত অধিক মনোযোগী ছিলেন যে, কোন প্রয়োজনকেই তিনি অধ্যয়নের উপর অগ্রাধিকার দিতেন না এবং কোন প্রতিবন্ধকতাই তাঁর মনোযোগে ব্যঘাত ঘটাতে পারতো না। জিরি মাদরাসায় শিক্ষক থাকাকালে একবার কতগুলো উড়োজাহাজ মাদরাসার উপর দিয়ে এক সাথে উড়ে যাচ্ছিলো। ঐ সময়টা ছিলো এমন যে, উড়োজাহাজ আবিষ্কার হয়েছে। তখনো বেশিদিন হয়নি বিশেষ করে এতদঞ্চলের লোকদেও তার উড্ডয়ন কমই দেখার কথা। ফলে উড়োজাহাজের গর্জন শুনতেই মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক সবাই তা দেখার জন্যে মাঠে নেমে পড়লো। কিন্তু তিনি আপন জায়গায় অধ্যয়নে মগ্ন রইলেন। তিনি নিজেই বলেছেন যে, আমি নিজেও দাঁিড়য়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আমার মনে হলো যে, উড়োজাহাজের উড্ডয়ন দেখা কিতাবের তামাশার চেয়ে অধিক বিস্ময়কর হতে পারে না। উঠিনি আমি। কেননা, কিতাবের অবস্থা তো হচ্ছে এই কবির ভাষায়-
گھر میں بیٹھکر ملک کی سیر + یہ تماشا ہم نے کتابوں میں دیکھا
ঘরে বসে দেশ ভ্রমণ, এই কান্ড দেখেছি কিতাবে।
وخير جليس فى الزمان كتاب
যুগে যুগে গ্রন্থই মানুষের সেরা সৎসঙ্গি।
সাহিত্য প্রতিভা ও কাব্যচর্চা :
ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে ছিলো তার স্বভাবগত রুচি। উর্দু ফার্সি, আরবী তিন ভাষারই গদ্যে এবং পদ্যে তাঁর সমান দখল ছিলো। তাঁর সাহিত্য কর্মে স্বভাবিক ভাবের ঢল নেমে আসতো। কৃত্রিম এবং পেশাদার সাহিত্যিকদের মতো কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করতে হতো না। একারণেই তাঁর ভাষা এবং কবিতায় বিশুদ্ধতা এবং অলংকারের পাশাপাশি ছিলো স্বাভাবিকতা, নিটোলতা এবং সুমিষ্টতা। এখানে উল্লেখযোগ্য চট্টগ্রামের বিখ্যাত কবি মাওলানা কাজী আবুল খাইর শামসীর রহ. পন্ডিমালার কিছু অংশ তিনি মুফতী সাহেবের কাব্যচর্চার প্রশংসা করে বলেন,
عزیز مصر بنگالہ ریاض شرع را لالہ+ نثار نظم رنگینش کنم عقد ثریا را
اگر بخشد خداوند دو عالم سلطنت شمسی+ بحسن بندشش بخشم سمرقند وبخا را را
অর্থ- তিনি বাংলার মিসরের আযীয, শরীয়তের কাননের রক্তিম গোলাপ, তাঁর রঙ্গিন কাব্যেও প্রতি আমি উৎসর্গ করবো আকাশের সাত তারকার ঝুমকা। দু’জাহানের প্রভু যদি শামসিকে রাজত্ব দান করেন, তাঁর কাব্যের ছান্দিক স্যেন্দর্যের জন্য আমি সমরকন্দ ও বোখারার রাজত্ব দিয়ে দিব।
আরবী সাহিত্যের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিলো। জাহেলী যুগ ইসলামী যুগ এবং মোখাদরম কাব্যেও এক বিশাল ভান্ডার তাঁর স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিলো। এতদসত্তেও তিনি শব্দতাত্তিক বিশ্লেষণে অধিকাংশ সময় কুরান এবং হাদীস থেকে প্রমান উপস্থাপন করতেন। কথিত আছে যে, সাহারানপুর মাদরাসায় ছাত্র থাকাকালে তাঁর আরবী ভাষার দক্ষতা দেখে হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেব রহ. তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি আরবী কোথায় শিখলে? আরবী গদ্যে তাঁর রচিত-
خير الزاد فى سير الضادএবং আরবীতে রচিত বিভিন্ন ফতওয়া উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত । আরবী পদ্যেعزيز الكلام فى مدح خير الأنام নামক একটি দীর্ঘ কবিতা এবং ফরায়েজের মতো কঠিন বিষয়েও তাঁর একটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর ব্যাপারে জনশ্রæতি আছে যে, এটি একটি ইলহামী (ঐশি ইঙ্গিত প্রাপ্ত কবিতা। কবিতার একটি পংক্তি থেকেও এরুপ ধারণা পাওয়া যায়। যেমন-
فاالله ألهمنى شويئ مديحه + بصميم قلبى اعمل الشكرانا
অর্থ- আল্লাহ পাক আমার অন্তরে নবীজি স. এর প্রসস্তিরভাব ইলহাম করেছেন, তাই দৃঢ় চিত্তে তাঁর শুকরিয়া আদায় করছি।
এ কবিতাটি যেন রাসুল সা. এর একটি ছন্দোবদ্দ সীরাত গ্রন্থ। আর نعم العروض এর ব্যাপারে তো হত বুদ্ধি হতে হয় , এ কিতাবে তিনি ‘ইলমে মিরাস’ (উত্তরাধিকার আইন) কে এত নিখুঁত ও নিটোলভাবে আরবী কাব্যে কিভাবে গ্রথিত করলেন, একবার হজ্জের সময় রাসূল স. এর পবিত্র রওজার পাশে উপস্থিত হলে তাঁর অন্তরে কয়েকটি কবিতার উদ্রেক হয়। পরবর্তিতে পটিয়া মাদরাসার মসজিদে তিনি সেগুলো পড়ে শুনিয়েছিলেন। পংক্তিগুলো হচ্ছে
والكعبة البيت الشريف طوافها فرض
الأمم
روحى فدى لجزيرة عربية فيها الحرم
সেই আরব দ্বীপের জন্য আমার জান কুরবান হোক, যেখানে হারাম শরীফ ও পবিত্র কাবাগৃহ, যার তওয়াফ করা সমগ্র মানবগোষ্টির জন্যে ফরয করা হয়েছে।
أنوارها طلعت على الأفاق وانجلت الدنى
وأضاءت الأطراف والأكناف وانزوت الظلم
তার আলোকচ্ছটা দিগন্তে উদিত হয়েছে। সারা দুনিয়া সমুজ্জ্বল হয়েছে। আলোকিত হয়েছে দুনিয়ার সব আনাচ কানাচ এবং নিঃসরিত হয়েছে অন্ধকার রাজী।
روحى فدى لمدينة مجرى ينابيع الهدى
ولروضة فى مهدها نام النبي المحترم
সেই পবিত্র নগরী মদীনার জন্যে জান কুরবান হোক, যেখানে হেদায়াতের ঝর্ণাধারা প্রবাহমান। আর সেই রাওযার জন্যে যার দুলনায় ঘুমিয়ে আছেন প্রিয় নবী স.
يأيتهما الزوار من فج عميق شاسع +
بركات كل منها هطالة فوق الديم
সেখানে অনেক দূর দুরান্ত হতে আসতে থাকে দর্শনার্থীগণ! উভয় হারামের বরকত মুষলধারে বৃষ্টির চেয়েও বেশি বর্ষে থাকে সদা সর্বদা।
ফার্সি ভাষায় তাঁর বহু কবিতা রয়েছে। ছাত্রজীবনে একবার সাহারানপুর মাদরাসার সভায় আল্লামা শিব্বির আহমদ ওসমানী রহ. এবং হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রহ. প্রমূখ মনীষীদের উপস্থিতিতে ফার্সি কবি মোল্লা জামির অনুকরণে তিনি একটি স্বরচিত ফার্সি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। তাতে শ্রোতা মন্ডলী দারুণভাবে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জন্যে দোয়া করেছিলেন। এ ঘটনাটি পটিয়া মাদরাসার সাবেক নায়েবে মুহতামিম হযরত মাওলানা ওবাইদুর রহমান সাহেব রহ. চাক্ষুষ দেখে বর্ণনা করেছেন।
أحن شوقا الى ديار لقيت فيها جمال سلمى+ دلم زشوق وصالش آید زسینہ بیروں بصد تمنا
مظاہر علم دین احمد کند دلالت بر اسم کویش+ کہ خاک آں گشت تو تیائے منورہ چشمہائے دلہا
زفیض حضرت خلیل احمد شگفتہ شد غنچۂ دہانش+ رسید صیت جمال وحسنش بمصر وقریہ بدشت وصحرا
بعبد رحماں نکتہ سنج علوم عقلی ، فنون نقلی+ جمال دنیا کمال عقبی، کمال دنیا جمال عقبی
শেষ বয়সে তিনি ফার্সি ভাষায় দরূদ ও সালাম সম্বলিত একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছিলেন। এতে তিনি উচ্ছাসিত প্রেমানুরাগের সহিত রাসুলুল্লাহ স. এর মার্যাদা তুলে ধরেছেন প্রত্যেক শ্লোকের শেষে দরূদ এবং সালাম পাঠ করেছেন। এটি পড়লে হৃদয় রাসূল প্রেমে উজ্জিবিত হয়ে উঠে। তাই অনেক রাসূল প্রেমিক এই কবিতাকে স্বীয় অজীফা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। উক্ত কবিতা ফার্সি ভাষায়ও তাঁর দক্ষতার স্বাক্ষর বহন করে। কবিতাটি আলাদা পোস্টারাকারে মুদ্রিত হয়েছে। এবং এ গ্রন্থের উর্দু সংস্করণে ছাপা হয়েছে। । যারা ফার্সি ভাষা বুঝেন তাদেরকে মূল কিতাব দেখে নেওয়ার অনুরোধ করছি। (অনুবাদক)
উর্দুতে তাঁর গদ্য এবং পদ্য দুটোই ভাষা মাধুর্যেও পাশাপাশি প্রাঞ্চলতা , স্বাভাবিকতা এবং বাস্তবধর্মীয়তায় পরীপপুর্ণ ছিল। তাঁর উর্দু গদ্য কে আল্লামা হালীর গদ্যেও সাথে তুলনা করা যায়।
তিনি ফতওয়া ,ফরায়েজ ও চিঠিপত্র সাধারণত উর্দুতে লিখতেন। সেসব লেখা তাঁর সাহিত্য প্রতিভার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে। পদ্যসমূহ হামদ নাত ও বিভিন্ন ইসলামী বিষয়াবলি এবং দোয়া ও মোনাজাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ দেখা যায়। এখানে উর্দুে ত লিখিত মোনাজাতের কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপন করা হলো:
شراب محبت پلادے خدایا+ محبت کی آتش جلادے خدایا
محبت میں تیری مٹادے خدایا+ تیرے در سے مجھکو لگادے خدایا
جلن تو نے دی ہے مرے دل میں یا رب+ جلن کی دوا اب ملا دے خدا یا
تجھے ڈھونڈتا ہوں تجھے ڈھونڈتا ہوں + ترے رہ کدھر ہے بتا دے خدایا
نہ عزت کی تمنا ہو نہ دولت کی مجھے خواہش+ ترے در کا بنا دیوانہ مجھکو اے مرے مولا
نہ راحت کی تقاضا ہو نہ خواہش کی غلامی ہو+ ترے در کا بنا مستانہ مجھکو اے میرے مولا
نہ پیری کی ضرورت ہے نہ شیخی کی مجھے حٓجت+ تری آتش کا پروانہ بنا مجھکو مرے مولا
جسے چاہے تو دولت دے مجھے مست محبت کر+ کدھر باغ محبت اب بتا مجھکو مرے مولا
যেহেতু কৈশোর ও যৌবনের শুরু থেকেই তাঁর মন মেজাযে যুহদ তাকওয়া (দুনিয়া বিমুখতা ও খোদাভীতি) এবং তাসাওফ (সুফিতত্ত) এর ছাপ ছিলো, তাই এতো শক্তিশালী কাব্য প্রতিভা এবং ভাষা সাহিত্যের সহিত স্বভাবগত সম্পকর্ থাকা সত্তেও কারো প্রশংসা কিংবা নিন্দা অথবা দুনিয়াবী স্বার্থ সিদ্ধি কিংবা স্বীয় সাহিত্য প্রবৃত্তির চাহিদা মিটানের জন্য কাব্য চর্চার কোন দৃষ্টান্ত তাঁর জীবনে খুজে পাওয়া যায়না। প্রকৃতপক্ষে এ ধরণের প্রথাগত কাব্যচর্চা একজন সংস্কারক ও দ্বীন প্রচারকের মার্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণও নয়। কেননা রাসূল স. এর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন- وماعلمناهالشعروماينبغىله
অর্থাৎ- আমি তাকে কাব্যকলা শিক্ষা দেয়নি। আর এটা (কাব্যচর্চা) তাঁর জন্য শোভনীয়ও নয়।
এটা হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর সাহিত্য প্রতিভা ও কাব্যরুচিরই প্রভাব যে, তাঁর ছাত্রদেও মধ্যে অনেক বড় বড় কবি, সাহিত্যিক জন্ম নিয়েছেন। যারা উর্দু, ফার্সি ও আরবী পদ্য ও গদ্যে তো পরাকাষ্ঠা অর্জন করেছিলেন যে, যদি বাংলাদেশের কোন সাহিত্যের ইতিহাস রচিত হতো তাহলে এদের নাম সবার শীর্ষে স্থান পেত। এবং তাদের কবিতা ও সাহিত্য উৎকৃষ্ট সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো। তাদের অধিকাংশেরই উৎপত্তি জিরি মাদরাসায় শিক্ষকতাকালে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, হযরত মাওলানা আহমদ সাহেব (প্রকাশ ইমাম সাহেব) মোহরাবী রহ. সাবেক প্রধান শিক্ষক পটিয়া মাদরাসা, পটিয়া মাদরাসার সাবেক আরবী সাহিত্যিক হযরত মাওলানা আলী আহমদ খীলি রহ., জিরি মাদরাসার সাবেক মুহতমিম ও মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা মুফতী নূরুল হক সাহেব রহ., হযরত মাওলানা ইসহাক গাজী সাহেব রহ. হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ ইব্রাহিম সাহেব রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ দানেশ রহ., এবং মাওলানা কাজী আবুল খায়ের শামসী রহ. প্রমুখ।
পরবর্তিতে পটিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি শিক্ষাদানের দায়িত্ব থেকে এক প্রকার হাত গুটিয়ে ফেলেন। তবুও মাদরাসা পরিচালনা ও দাওয়াতি কাজে থাকা সত্তেও তাঁর মাঝে জ্ঞানগত ও সাহিত্যগত গুণ প্রবল ছিলো। এমনকি কবিতা ও কবিত্ব এই মাদরাসার বৈশিষ্ট হয়ে দাড়িয়েছিল। পটিয়াতে যেসব ছাত্র সাহিত্য গুণ ও কাব্যকলায় তাঁর শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হয়েছেন তাদের মধ্যে মরহুম মাওলানা হারুন ইসলামাদী, মাওলানা আব্দুল হক সলিম এবং মাওলানা কামাল উদ্দিন রহ. খাগরাভী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানিতে এ গ্রন্থকার সর্বাধিক উপকৃত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছে। হযরত মুফতী সাহেবের শুভদৃষ্টির ফলশ্রুতিতে উর্দু কাব্যে উর্দু ভাষাভাষীদের কবিতা আসরে দু’দুবার সভাপতিত্ব করার এবং স্বরচিত কবিতা পাঠের দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন হয়েছে আমার। ছাত্র থাকাকালে যখন কোন মেহমান আসতো তখন হযরত মুফতী সাহেব রহ. আমাকে পদ্যে মানপত্র লেখার নির্দেশ দিতেন। দু-একবার আমি কবিতা লিখলে তিনি নিজ হাতে তা সংশোধন করে দিয়েছেন। কোন কোন সময় তিনি এক বা একাধিক পংক্তি লিখে একই ছন্দে কবিতা সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিতেন। তাঁর জুতা উঠানোর ফলশ্রæতিতেই আমার মতো অযোগ্য ব্যক্তির পক্ষে “কুল্লিয়াতে যওক” (কবিতা সমগ্র বা সম্ভার) প্রকাশ করার সাহস হয়েছে। শিক্ষা সমাপনির পর একবার পটিয়া মাদরাসার সভায় উপস্থিত হলে অন্যন্য প্রাক্তন ছাত্রদেরকে যেখানে তিনি সভার কাজ কিংবা মেহমানদের সেবার নির্দেশ দিলেন, সেখানে আমাকে হুকুম করলেন, কবিতা লিখতে। আজকে সেই প্রিয় দিনগুলো এবং আযীযী উদ্যানের সেই দিবা-নিশির স্মৃতি মনে পড়ে হৃদয়ে বিরহ-ব্যথা কাটাঁর মতো বিঁধতে থাকে।
ইলমে হাদীস ও ইলমে তাফসীরে তাঁর দক্ষতা:
যেসব সৌভাগ্যবানদের হযরতের শিক্ষার আসরে বসার সুযোগ হয়েছে তারাই প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে যে, তাফসীর ও হাদীস উভয় বিষয়ে তাঁর কতই দক্ষতা ছিলো। তাফসীরের পাঠদানের সময় তিনি শব্দতাত্তিক এবং বাক্য বিন্যাস পর্যালোচনার মাধ্যমে কুরআনের মূল ভাষা কিংবা তাফসীর গ্রন্থের এবারতকে বোধগম্য করে তোলে অত্যন্ত সহজভাবে গ্রহনযোগ্য তাফসীরসমূহের সারকথা পেশ করতেন। আর কুরআনের অনুবাদ তিনি এমনভাবে করতেন যে, শ্রোতার কাছে মনে হতো যে, যেন কুরআনের এই আয়াতগুলো এখন নাযিল হচ্ছে। আর হাদীসের পাঠতো দান করতেন একেবারে শাস্ত্রীয় কায়দায়। রিজাল বা হাদীস বর্ণনা কারীদের সম্পর্কে বিশদ আলোচনা এবং হাদীসের বিশুদ্ধতার উপর সমালোচনামূলক বক্তব্য রাখতেন। শেষ বয়সে দেখা গেছে যে, পটিয়ায় মুসলিম শরীফের পাঠ তাঁর কাছেই হতো। কিছুদিন তিরমিযিও পড়িয়েছেন। তাঁর পাঠের আসরে বসলে মনে হতো যেনো প্রাচীন কালের কোনো বড় মুহাদ্দিসের আসরে বসেছি। হাদীসে তিনি যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর শিষ্যত্ব লাভ করেছেন। কোন কোন সুত্রে এ কথাও জানা যায় যে, তিনি শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. থেকে ও হাদীসের অনুমতি লাভ করেছেন।তার বিশিষ্ট খলীফা মিরসরাইস্থ জামালপুর হাফেজুল উলুম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা বজলুস সোবহান সাহেব রহ. বলেছেন যে, একবার হযরত মুফতী সাহেব রহ. হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ আহমদ সন্দীপী সাহেবের সম্মুখে সিহাহ সিত্তা (হাদীসের ছয় প্রমান্য গ্রন্থ ) এর কয়েকটি কিতাব নিয়ে উপস্থিত হয়ে যথাযথ সম্মান ও আদরের সহিত পড়তে লাগলেন। হযরত মুহাদ্দিস সাহেব তাঁকে তার পক্ষ থেকে হাদীস বর্ণনা ও পাঠদানের অনুমতি নিয়ে নিলেন। তার হৃদয়ে হযরত মুহাদ্দিস সাহেবের প্রতি অগাধ ভালবাসা ও ভক্তি শ্রদ্ধা ছিলো। অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে তাঁর নাম মুখে নিতেন। এতবড় মুহাদ্দিস হওয়া সত্তেও তিনি এত বিনয়ী ছিলেন যে, দাওরা হাদীসের ছাত্রদের বর্ষ সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি জিরি মাদরাসার শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব রহ. এর মাধ্যমে সিহাহ সিত্তার কিতাবসমূহের পাঠ শেষ করাতেন। এছাড়া যখনই কোনো বুযুর্গ মুহাদ্দিস আগমন করতেন, তিনি ছাত্রদেরকে তাঁর কাছে উপকৃত হওয়ার জন্যে সুযোগ করে দিতেন এবং নিজেও আগত মুহাদ্দিসের পাঠদানের আসরে অংশগ্রহণ করতেন।
ফিকহ ও ফতওয়ায় তাঁর অনন্য যোগ্যতা :
فقاهت ফুকাহাত তথা ফিক্হ শাস্ত্রীয় চরমোৎকর্ষতাই তাঁর পুরো জীবনে মৌলিক যোগ্যতার পদার্থ স্বরুপ প্রতীয়মান ছিলো। তিনি অবোধ লিপিকারের মতো শুধু ফতওয়ার অনুলেখক ছিলেন না । কোন মাসআলাকে তার প্রমাণসহ বুঝা একটি বিশেষ বিষয় বা ঘটনাকে আরেকটি বিশেষ বিষয় বা ঘটনার সাথে সামাঞ্জস্য বিধান করা কিংবা কোনো সুত্রের অধীনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ যোগ্যতা ছিলো। বহ্যত তাঁকে দুনিয়াবী কাজকর্ম , বেচা-কেনা, লেন-দেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হতো, কিন্তু বাস্তবে তিনি কাজ-কারবারে বড়ই পাকা এবং দেশের রীতি নীতি সম্পর্কে খুবই অবহিত ছিলেন। ফিকহের সাথে যাদের সম্পর্ক রয়েছে তাদের একথা জানা থাকবে যে, ইমাম আজম সাহেব রহ. এবং অন্যন্য হানাফী ইমামগণ অধিকাংশ মাসআলায় সমাজিক রীতি-নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। হযরত মুফতী সাহেবও একই পন্থায় কাজ করতেন। বিশেষ করে তালাক ইত্যাদি যেসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট লোকেরা কারচুপি ও ছল চাতুরির আশ্রয় নিয়ে থাকে, এসব ক্ষেত্রে তিনি শুধুমাত্র মৌখিক প্রশ্নের ভিত্তিতে ফতওয়া দানের নীতি অবলম্বন করতেন না; বরং ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের স্বাক্ষ্য কিংবা নিজস্ব কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে তদন্তের পর ফতওয়া প্রদান করতেন। তদুপরি যেসব দেশে ইসলামী আইন প্রচলিত নেই এবং কোন শরয়ী বিচারের ব্যবস্থা নেই , সেই দেশগুলোর ব্যাপারে ফকীহগণ লিখেছেন যে, মুসলমানদের মধ্যকার পঞ্চায়েত বিচারকের স্থলাভিষিক্ত হবে। আবার কোনো কোনো মাসআলায় المرأة كالقاضىনারীকে বিচারকের মতো বলা হয়েছে। এ কারণে এসব স্থানে মুফতীর জন্যে মৌখিক বিবরণের ভিত্তিতে ফতওয়া দানের নীতি অবলম্বন করে ধর্মীয় ব্যাপারে ফতওয়া প্রদান করাকে তিনি বৈধ মনে করতেন না; বরং তাঁর মতে মুফতীর নিকট বিষয়টি পেশ হলে তিনি বিচার বিভাগীয় রীতি অনুসারে ফায়সালা করতেন। বাস্তব অভিজ্ঞতানুসারে বলা যায় যে, এসব অঞ্চলের মুসলমানরা মুফতীকে বিচারক মেনে থাকেন। তাই তারা শুধুমাত্র ধর্মীয় বিধান শুনিয়ে দিয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পেতে পারে না। এই ইজতেহাদী শক্তি ফিকহশাস্ত্রিয় দূরদৃষ্টি , সামাজিক রীতি নীতি সম্পর্কে অবগতি, হানাফী মাজহাবের সঠিক জ্ঞান, জন সাধারণের মানসিকতা উপলব্ধি এবং বুদ্ধিবৃত্তির নূর (জ্যেতি) তাঁর ফতওয়াকে বিশিষ্ট মার্যাদার অধিকারী করে তুলেছে। অবশ্য এ বৈশিষ্টের জন্যে তাঁকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। কারণ তাঁকে বড় বড় নামকরা আলেম এবং মুফতীগণের বিপরীত ফতওয়াদান করতে হয়েছে। যেমন, মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী ফয়জুল্লাহ রহ. এর সাথে তিনি কিছু মাসআলায় একমত হতে পারেন নি। অথচ তিনি তাঁকে স্বীয় মুরব্বীদের কাতারে গণ্য করতেন এবং খুবই সম্মান করতেন। পদুয়া মাদরাসার প্রধান মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল গণী সাহেব রহ. বলেন যে, তিনি হযরত মাওলানা মুফতী ফয়জুল্লাহ রহ. এর সাথে কতক মাসআলাতে দ্বীমত পোষণ করতেন, কিন্তু ঐসব মাসআলার আলোচনা উঠলে তিনি বলতেন যে, উনি আমাদের মুরব্বিদের একজন। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও অধ্যবসায় খুবই ব্যাপক। তাঁর ব্যাপারে ভূল ধারণা পোষণ না করা চাই। তিনি আমাদের সংস্কারক ও সংশোধক। তাঁর সংস্কার না হলে হয়তো আমরা সীমালঙঘন করে ফেলতাম।
চারিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা হাফেজ ফজল আহমদ সাহেব বলেন যে, হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব একবার হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেবের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, আমি মুরব্বিদের সকলের দরজার ভিখারী। কেউ যেনো আমার কোনো কথা এসব মনীষীদের নিকট পৌঁছিয়ে আমার সম্পর্কে তাদের হৃদয়কে বিষাক্ত করে না তোলে।
এ জন্য আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে যে, যখন তিনি মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেবকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন তখন আমাদের মতো নগণ্য লোকদের জন্যে যথাযথ বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে শুধূমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে ওসব মনীষীদের জ্ঞানগত মত পার্থক্যের ব্যাপারে কোনো প্রকার মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া কিছুতেই সমীচীন হতে পারে না। এ ব্যাপারে আমাদের ব্যক্তব্য হলো এই যে, হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব বড়ই নিষ্ঠাবান, সুন্নাতের অনুসারী, ফিক্হের খুঁটিনাটি বিষয়ে অবহিত এবং সরল প্রকৃতির বুজুর্গ ছিলেন। তাঁর মতবিরোধ নিছক প্রবৃত্তিজনিত উদ্দেশ্য কিংবা বিদ্বেষ ইত্যকার কোনো কিছুর উপর ভিত্তিশীল ছিলো না; বরং তিনি নিজের গবেষণা অনুযায়ী যা কিছু সত্য মনে করতেন, কারো তিরস্কারের তোয়াক্কা না করেই নির্ভয়ে তা বলে ফেলতেন এবং তার উপর পাহাড়সম অবিচল থাকতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে একদিকে শিষ্য শাগরিদ এবং শুভানুধ্যায়ীগণ মত বিরোধকে ফুলিয়ে-ফাঁফিয়ে উভয়ের মধ্যকার দূরত্বকে সাগর সম করে ফেলেছে। অন্যদিকে তাঁর অর্জনতা, দুনিয়া বিমুখতা এবং সরল প্রকৃতিরও বড় প্রভাব পড়েছে। কোনো কোনো ফতওয়ার সাথে বিদ’আতকে প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে তাঁর ভ‚মিকা ছিলো অত্যন্ত কঠোর। অবশ্যই সকল যুগের সংস্কারকেরই এই অবস্থা হয়ে থাকে। নি¤েœ মুফতী ফয়জুল্লাহ রহ.-এর সাথে মুফতী আযীযুল হক রহ.-এর মতানৈক্যপূর্ণ কিছু মাসআয়ালা পেশ করা হলো।
পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন এবং টেলিফোনের সংবাদের ভিত্তিতে চাঁদ দেখার ঘোষণা দেয়া :
চাঁদ দেখার ব্যাপারে হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব রহ. পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন এবং টেলিফোনের সংবাদকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন না। পক্ষান্তরে হযরত মুফতী আযীযুল হক রহ. বলতেন যে, যদি ইসলামী রাষ্ট্র না হওয়ার দরুণ শরয়ী বিচারব্যবস্থা না থাকে, তাহলে কোন শহরে চাঁদ দেখা গেলে তাঁর ব্যাপারে স্বাক্ষ্য গ্রহনের দায়িত্ব হচ্ছে আলেম সমাজ এবং দ্বীনি নেতৃবৃন্দের। গ্রামবাসীদের উপর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা কর্তব্য নয়। কেননা, ফিক্হ ও ফতওয়ার কিতাবে আছে যে, যদি শহরে চাঁদ দেখার প্রতীক হিসেবে ঢোল কিংবা সাইরেন বাজানো হয়, তাহলে গ্রামবাসীদের ঈদ করা জায়েয। আজকাল টেলিফোনে লাখো কোটি টাকার লেন দেন নিষ্পত্তি হচ্ছে। কে কথা বলছে তা নিরূপণ করা ও সম্ভব হচ্ছে। যেমন পরিচিত কোন বন্ধু কিংবা আত্মীয়ের সাথে কথা হচ্ছে, মাঝখানে সে জানিয়ে দিল যে, আজ আমাদের এখানে চাঁদ দেখা গেছে, তাহলে আগে পরের সকল কথা যদি মেনে নেয়া যায় , তবে কেন মধ্যখানে চাঁদ দেখার খবরকে মেনে নেয়া যায় তবে কেন মধ্যখানে চাঁদ দেখার খবরকে সত্য বলে মেনে নেওয়া যাবে না? বিশেষ করে বর্তমানে দেশের বিশ্বস্থ আলেমদের সমন্বয়ে হেলাল কমিটি গঠিত হয়েছে। উক্ত কমিটির পক্ষ থেকে রেডিও এবং পত্রিকায় ঘোষণা দিলে ঐ খবরকে গ্রহণ না করার কোন কারণ নেই। তবে হ্যাঁ,ঈদের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার শর্ত একটু কঠিন বৈ কি। যার বিস্তারিত বিবরণ হযরত মুফতী শফী সাহেবের ‘চাঁদ দেখা’ পুস্তিকায় বিধৃত আছে। হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেবও (রহ.) উক্ত বিস্তারিত বিবরণের বিরোধী ছিলেন না। এ ব্যাপারে তাঁর স্বতন্ত্র পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়েছে।
ক্রুদ্ধ ব্যক্তির তালাক: (তালাকুল গজবান)
ক্রুদ্ধ ব্যক্তির তালাকের ব্যাপারে হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব রহ. প্রায়শই কসম সাপেক্ষে তালাকদাতা স্বামীর কথা গ্রহণ করতেন। অর্থাৎ যদি কেউ বলে যে, তালাক দেওয়ার সময় আমার এতই ক্রোধ ছিল যে, আমার চেতনা শক্তি কার্যকর ছিল না। ফলে আমি কি বলছি তা আমার জানা নেই। আর আমার তালাক দেওয়ার ইচ্ছাও ছিলো না। তাহলে তিনি শপথ গ্রহণ পূর্বক لا يعلم لا يريد সে (জানেনা এবং ইচ্ছাও করে নাই) মূলনীতির অধীনে তালাক পতিত হয়নি মর্মে রায় প্রদান করতেন। পক্ষান্তরে হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব রহ. এ ধরনের লোকের ব্যাপারে ঘটনার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এলাকার বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের লিখিত সত্যায়নপত্র চাইতেন। অনেক সময় আবার নিজের পক্ষ থেকে তদন্তকারী পাঠাতেন। তিনি ক্রোধজনিত অচেতন হওয়ার দাবিদার ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করতেন যে, তুমি তালাক শব্দ উচ্চারণের আগে ও পরে কী কী বলেছিলে? কী কী কাজ করেছিলে? যখন সব কিছু ঠিক ঠিক উত্তর দিতো, তখন তিনি বলতেন যে, শুধুমাত্র তালাকের সময় বুঝি তোমার হুশ ছিলো না। আর আগে পরে হুশ ছিলো? তিনি এধরণের দাবি গ্রাহ্য করতেন না। কেননা , তাঁর তদন্তে এবং জেরায় মিথ্যাবাদীর দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়তো। পাকিস্তানের মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী সাহেব রহ. লিখেছেন যে পরিমাণ ক্রোধে তালাক পতিত হয় না সেই পরিমাণ ক্রোধ হাজারে দু-একজনের হয়ে থাকে। (কিতাবুত তালাক : ফতওয়া দারুল উলুম)।
উচ্চস্বরে যিকর:
হযরত মুফতীয়ে আজম মুফতী ফয়জুল্লাহ রহ. উচ্চস্বরে যিক্র করাকে বিদ’আত বলতেন এবং দলিল হিসেবে নি¤েœাক্ত হাদীস পেশ করতেন। হুযুর স. এরশাদ করেন, إنكم لا تدعون أصم ولا غائبا অর্থাৎ- তোমরাতো কোন বধির কে ও কোন অনুপস্থিত কে ডাকছো না। তিনি আরো বলতেন এতে নামাযীর নামাযের ক্ষতি হয় ও ঘুমন্তের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পক্ষান্তরে হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব রহ. বলতেন, উক্ত হাদীসে বিকট শব্দে যিক্র করার নিন্দা এসেছে। যেমন হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. মিশকাতে শরীফের বিখ্যাত টিকাগ্রন্থ “লামাআত” এ বলেন:
المنع للتيسير والإرفاق لا لكون الجهر غير مشروع
অর্থাৎ: উক্ত হাদীসে যে নিষেধ এসেছে, তা নির্দেশনামূলক। বাধ্যতামূলক নয়। প্রকৃতপক্ষে নিষেধ এসেছে সহজ ও নমনীয় পন্থা অবলম্বন করার জন্যে, উচ্চৈস্বরে যিক্র অবৈধ করার জন্যে নয়। যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. “ফয়জুল বারী” গ্রন্থে বলেন:
وليس فيه نهى عن الجهر ولا ذم عليه
অর্থাৎ উক্ত হাদীসে উচ্চৈস্বরে যিক্র করার কোন নিষেধাজ্ঞা এবং কোন নিন্দাবাদও নেই।”
শেষ রাতে রুমন্তদের জাগানের ব্যাপারে তো হাদীস শরীফে উৎসাহ দানমূলক বক্তব্য এসেছে। স্বয়ং নবীয়ে করিম স. এর আমল বর্ণনা করে হযরত আয়েশা রা. বলেন,
فإذا سجد غمزنى فقبضت رجلى
অর্থাৎ“হুজুর শেষ সিজদায় গেলে আমাকে গুতো দিয়ে জাগতে বলতেন, আর আমি পা গুটিয়ে ফেলতাম।” হুজুরের হাদীসে ক্বওলী তথা মৌখিক বর্ণনায় এসেছে-
لا يغرنكم أذان بلال فإنه ينادى بليل ليرجع قائمكم ولينبه نائمكم
অর্থাৎ-বেলালের আজান তোমাদেরকে ফজর হয়েছে মর্মে ধোঁকা না দেয়া চায়। কেননা সে রাত থাকতেই আজান দেয়, তোমাদের জাগ্রতদের ফিরানোর জন্যে এবং ঘমন্তদের জাগানোর জন্যে ”।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মিরকাতে বলা হয়েছেযে, হযরত বেলাল র. রাত থাকতে আযান দিতেন, মানুষকে তাহাজ্জুদ ও সাহরীর জন্যে জাগানোর লক্ষ্যে। ফতহুল বারীতে ইবনুল বাত্তালের কথা বলা হয়েছে-
قال ابن بطال فيه فضيلة صلاة الليل وإيقاظ النائمين
তিনি বলেন, এতে রাতের নামায এবং ঘুমন্তদের জাগানোর ফজিলত বিধৃত হয়েছে। মিশকাত শরীফে হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে-
رحم الله رجلا قام من الليل فصلى وايقظ إمرأته
অর্থাৎ- আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তিকে রহমত করুন যে রাতের কিছু অংশ জেগে নামায পড়ে এবং নিজের স্ত্রিকে জাগায়। হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব রহ. বলতেন যে, রাতের শেষ ভাগ ঘুমানোর জন্যে নয়, ঘুমন্তদের ব্যাঘাত হবে কেন? তদুপরি ভারসম্যপূর্ণ উচ্চৈস্বরের দরূণ ঘুমন্ত কিংবা নামাযীর ব্যঘাত হবে এটা মেনে নেয়া যায় না; বরং কামেল পীরের অনুমতিক্রমে চড়া স্বরেও যিক্র করা জায়েয আছে। এরূপই লিখিত আছে এমদাদুল ফতওয়ার মানহীয়্যাতে (১/১৪১) মসজিদের মধ্যে উচ্চৈস্বরে যিক্র করাকেও হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব রহ. মাকরূহ বলতেন। কিন্তু হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব রহ. এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মসজিদে কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ) এবং উচ্চৈস্বরে যিক্র করেন। এতে তাঁর অনুমতি রয়েছে। তিনি বলতেন যে, মসজিদে যিক্র করা থেকে নিষেধ করার ব্যাপারে কুরআনে হুমকি এসেছে-
ومن أظلم ممن منع مساجد الله أن يذكر فيها اسمه
অর্থাৎ- ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক জালেম কে যে আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নামের যিক্র করতে বাধা প্রদান করে? (বাকারা ১১৪) মুফতী শফী সাহেব রহ. আয়াতের অধীনে মা’আরেফ মাসায়েল শিরোনামে লিখেছন, মসজিদ যখন সাধারন মুসল্লি থেকে খালি হয়, তখন উচ্চৈস্বরে যিক্র কিংবা তেলাওয়াত করতে কোন অসুবিধা নেই। (মাআরিফুল কুরআান ১/১২৯)
এ ছাড়া বিভিন্ন হাদীসে মসজিদে জিকিরের কথা নীরবে কিংবা সরবে কোন প্রকার নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই এসেছে। হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী রহ. এর ফতওয়া এবং মাওলানা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর প্রামাণ্য লেখাও এর বৈধতা বুঝায়। এভাবেই তো পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী মনীষীদের আমল চলে আসছে। যেমন থানাভনের এমদাদিয়া খানকার মসজিদে উচ্চস্বরে যিক্র হতো। আবার শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. প্রতি বছর সিলেট আসলে মসজিদে উচ্চস্বরে যিক্র করাতেন। ভারতের কোন বিখ্যাত আলেমের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ আসেনি। এসব মনীষীদের ব্যপারে কী এমন ধারণা পোষণ করা যেতে পারে যে, তারা শরীয়ত বুঝেন নি কিংবা জেনে শুনে এর বিপরীত কাজ করতেন?
নির্ভরযোগ্য সুত্রে এ কথা জানা গেছে যে, হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব রহ. এর পীর সাহেব হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ মুহাদ্দিস সাহেব উচ্চস্বরে যিক্রের জন্যে উৎসাহ দিতেন। তাঁর নিকট কেউ হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেবের অস্বীকৃতির কথা জানালে তিনি বলতেন, “আরে মিয়া তোমরা উচ্চ কন্ঠে যিক্র করো, মুফতী সাহেব তো দুর্বল মানুষ।”
চল্লিশ দিনের এতেকাফ:
এভাবে চল্লিশ দিন এতেকাফকেও হযরত মুফতী ফযজুল্লাহ সাহে রহ. বিদআত বলতেন, পক্ষান্তরে হযরত মুফতী আযীযুল হক রহ. তাঁর অনুসারী এবং সংশ্লিষ্টদের চল্লিশ দিন এতেকাফের ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। সাধারণত তরিকতের মাশায়েখদের এটাই রীতি চলে আসছে। কিন্তু তিনি পটিয়াতে এসে ইতেকাফের দাওয়াত দিতেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ স্বীয় আত্মসংশোধনী এবং উপকারের জন্যে পবিত্র রমজানে পটিয়ায় এসে সমবেত হতেন।
হযযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব রহ. বলতেন যে, চল্লিশ দিনের আমলের একটা বিশেষ প্রভাব আছে, যেমনি হযরত মূসা আ. এর ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে এসেছে,
فأتم ميقاته اربعين ليلة (أعراف)
অর্থাৎ- তাঁর প্রভুর নির্ধারিত সময় চল্লিশ দিন পূরণ করলেন। এই আয়াতের অধীনে হযরত মুফতী শফী সাহেব রহ. বলেন, “এই আয়াতের ইশারা দ্বারা এ কথাও বুঝা যায় যে, বাতেনি অবস্থার সংশোধনির ক্ষেত্রে চল্লিশ রাতের বিশেষ একটি দখল আছে। যেমনি ভাবে একটি হাদীসে রাসূল স. বলেছেনে যে, যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন নিষ্টার সাথে আল্লাহ তাআলার এবাদত করবে, আল্লাহ তাআলা তার হৃদয়ে প্রজ্ঞার ঝর্ণা প্রবাহিত করন দিবেন। (রুহুল বয়ান, মাআরিফুল কুরআন)
চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাকবিরে উলার সাথে নামায আদায়কারিদের পক্ষে হাদীস শরীফে সুসংবাদ এসেছে। ইরশাদ হয়-
كتب له براءتان براءة من النار وبراءة من النفاق
অর্থাৎ তার জন্যে রয়েছে দুটি মুক্তি , একটি একটি জাহান্নাম থেকে অপরটি মুনাফেকি (দ্বিমুখিতা) থেকে। তিনি আরো বলেন শরাব বা মদ চল্লিশ দিন পর্যন্ত বোতলে থাকার পরে পরিশোধিত হয়। হাফেজ শিরাজী রহ. বলেন,
کہ اے صوفی شراب آنکہ شود صاف +کہ در شیشہ بماند ار بعینے
অর্থাৎ- হে সুফি! করাব চল্লিশ দিন যাবৎ বোতলে থাকলেই পরিষ্কার হয়। ইতেকাফ সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। তবে চল্লিশ দিনের সুন্নত। কেননা কোন বিষয়ের সুন্নত ও মোস্তাহাব প্রমাণিত হওয়ার জন্যে তার উপাদান একত্রিতভাবে রাসূল স. থেকে প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক নয়।
(فيض البارى , باب الذكر بعد الصلاة)
ওয়াজে কবিতা পাঠ:
মুফতীয়ে আজম হযরত মাওলানা মুফতী ফয়জুল্লাহ রহ. প্রাথমিক যুগে যখন ওয়াজ করতেন, ওয়াজে কাবিতাও পাঠ করতেন। বহু দ্বিনি বিষয়ে নিজেই কবিতা লিখেছেন। “পন্দনামায়ে খাকী” ইত্যাদি তাঁর বহু কাব্যগ্রন্থ ও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ওয়াজে কবিতা পাঠকে অস্বীকৃতি জানান। কবিতার নিন্দাসম্বলিত হাদীসসমূহ তিনি দলিল হিসেবে পেশ করতে লাগলেন। যেমনঃ
لأن يمتلئ جوف أحدكم قيحا يريه خير من أن يمتلئ شعرا
অর্থাৎ- হযরত নবী করীম স. এরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে কারো পেট পুঁজ দ্বারা পরিপূর্ণ হওয়া, কবিতা দ্বারা পরিপূর্ণ হওয়া অপেক্ষা উত্তম।”
হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব রহ. ওয়াজে দর্শনপূর্ণ কবিতা পাঠ করতেন। যা ওয়াজের বিষয়বস্তুরও সহায়ক হতো এবং বলতেন হাদীসে কবিতার প্রসংসাও তো এসেছে যেমন, হুজুর স. এরশাদ করেছেন, إن من الشعر لحكما أو حكمة অর্থাৎ- “কিছু কিছু কবিতা তত্ত¡দর্শন পূর্ণ হয়ে থাকে।”
আরো বর্ণিত আছে যে, الشعر كلام حسنه حسن وقبيحه قبيح অর্থাৎ- “কবিতা একটি কথা শিল্প। এর ভাল কে ভাল এবং মন্দকে মন্দ বলা যায়। হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর ওয়াজ হাকীমুল ইম্মাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর প্রায় সাদৃশ্য ছিলো, যাতে কুরআনে করিমের আয়াত, হাদীস শরীফ এবং ওলী বুজুর্গদেও অমূল্য বাণী বহু দৃষ্টান্ত ও কিস্সা কাহিনি ও তত্ত¡পূর্ণ কার্যকলা সবকিছুর সমাহার থাকতো। কবিতার প্রভাবকে তো কেউ অস্বীকারকরতে পারে না। যখন স্বয়ং নবী আকরাম স. হযরত হাস্সান র. কে কুরাইশের নিন্দা সম্বলিত কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ইরশাদ করেন:
اهج قريشا فإنه أشد عليه من رشق النبل
অর্থাৎ- “ কোরাইশের নিন্দা ও ভর্ৎসনা সূচক কবিতা পড়ো”। কেননা তাদের জন্যে কবিতার আঘাত তীরের আঘতের চেয়ে মারাত্মক।
এ জন্য ওলামায়ে কেরাম এধরনের কবিতাকে শুধু বৈধ বলেননি; বরং এটাকে কাব্য জিহাদ আখ্যায়িত করেছেন। হযরত হাস্সান র. কবিতা আবৃত্তিকালে নিজের মধ্যে জেহাদের উদ্দিপনা ও স্বাদ অনুভব করতেন। কেননা তিনি তাঁর কবিতাকে হুজুর স. ও তাঁর দ্বীন ইসলামের পক্ষে প্রতিরোধের কাজে লাগতেন। কুরআন সুন্নাহর বিষয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ যে কোন কবিতা প্রশংসনীয়। এজন্য হুজুর স. জাহেলী যুগের প্রখ্যাত কবি লবিদের প্রশংসায় বলেন,
اصدق قول قاله الشاعر كلمة لبيد ألا كل شيئ ما خلا الله باطل
অর্থাৎ- কবিরা যেসব কবিতা বলেছেন, তৎমধ্যে সর্বাধিক বস্তুনিষ্ট হচ্ছে লবিদের এ কবিতাংশ “আল্লাহ ব্যতিত সবকিছুই মিছে।”
আরেকজন জাহেলী কবি উমাইয়া বিন আবিস্সলতের কবিতা হুজুর স. একজন সাহাবির মুখে শুনছিলেন। প্রতিবার বলতেন আরো শুনাও। এভাবে একশতের বেশি কবিতা শুনলেন। অনুরূপভাবে হুযুর স. প্রখ্যাত জাহেলী কবি আনতারার এই কবিতা পংক্তি খুবই পছন্দ করেছেন-
واغض طرفى حين تبدو جارتى + حتى يوارى جارتى مأواها
অর্থাৎ- আমার প্রতিবেশি যুবতি দৃশ্যমান হলে আমি আমার দৃষ্টি অবনত করে ফেলি। যতক্ষণ না আমার প্রতিবেশি যুবতি তার ঠিকানায় অদৃষ্ট হয়ে যায়। আনতারার এ কবিতা লাইন কুরআনে করিমের নি¤েœাক্ত আয়াতের সাথে সংগতিপূর্ণ। । কুরআনে করিমে এসেছে-
قل للمؤمنين يغضوا من أبصارهم ويحفظو فروجهم
অর্থাৎ- “আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন যে, যেন তারা দৃষ্টি অবনত করে এবং লজ্জাস্থান এর হেফাজত করে।”
মোদ্দা কথা হলো যেসব কবিতা কুরআন-হাদীসের সাথে সংগতিপূর্ণ হয় এবং মুসলমানের হৃদয়ে দ্বীনি অনুভ‚তি সৃষ্টি করে সেসব কবিতা কখনো গর্হিত ও নিন্দনীয় হতে পারে না। কেউ পড়ুক বা শুনুক কিংবা ওয়াজের মাঝে মাঝে দৃষ্টান্তস্বরূপ পাঠ করুক এ ধরণের কবিতাকে হিকমত তথা দর্শনে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বরং স্বীয় বক্তব্যকে দ্রæত গতিতে মানুষের হৃদয়পটে অবতারণের লক্ষ্যে কবিতাকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা প্রত্যেক ওয়ায়েজ ও মুবাল্লিগের জন্যে অপরিহার্য। কেননা কবিতার প্রতিক্রিয়া গদ্যের তুলনায় অত্যন্ত দ্রæত ও জোরালো হয়। গদ্যের প্রতিক্রিয়া সাধারণত অনুভুতিশীল হয়ে থাকে। আর পদ্য অনেকটা অজ্ঞাত পন্থায় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তবে আল্লাহ তাআলা কুরআন করীমকে কাব্যকলা থেকে অনেক দূরে রেখেছেন। যেমন বলা হয়েছে
وما هو بقول شاعر
অর্থাৎ- সে কুরআন তো কোন কবির বক্তব্য নয়”
তেমনি হুজুর স.এর বাণী কে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বানী হওয়া সত্তে¡ও কাব্য প্রবৃত্তি থেকে পুতঃপবিত্র রেখেছেন। যাতে মানুষ কোরআনে করিম ও হুজুর স. এর বাণী সমূহকে কাব্যিক অতিরঞ্জণ আখ্যায়িত না করে এবং হুজুর স. কে কবি মনে না করে। কেননা নবীদের পদ মার্যাদার জন্যে এটাই সংগতিপূর্ণ ছিলো।
ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাত:
মুফতীয়ে আজম হযরত মাওলানা মুফতী ফয়জুল্লাহ রহ. জীবনের শেষ পর্যায়ে ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতকে বিদআত আখ্যায়িত করেছেন। প্রথমদিকে তিনি নিজেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সম্মিলিত মুনাজাত পরিচালনা করতেন। অনেককাল তা অস্বীকারও করেন নি ; বরং এমন এক সময় ও অতিক্রান্ত হয়েছে যে, ফরজের পর নফল আদায় করে সম্মিলিত যে মুনাজাতের প্রথা চালু আছে তাকে বিদআত এবং ফরজের পর মুনাজাতকে সুন্নাত প্রমান করে আমাদের ওলামারা ফতওয়া দিয়েছিলেন। হযরত মুফতী ফযজুল্লাহ সাহেব রহ. উক্ত ফতওয়ায় দস্তখত করেছিলেন। এর জন্যে দেখুন-
النفائس المرغوبة بعد المكتوبة
কিন্তু তিনি জীবনের শেষ পর্যায়ে ফরজের পর সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কে ভিন্ন মত অবলম্বন করলেন। যা দেওবন্দি মতের সমস্ত ওলামা মায়ায়েখ ও সুফী-সাধকদের স্বতসিদ্ধ প্রক্রিয়ার পরীপন্থী। হযরত খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ রহ. হযরত মুফতীয়ে আযম সাহেবের বিশিষ্ট শাগরেদ ও খলিফা হওয়া সত্তেও এ মাসআলায় আপন শেখের সাথে একমত হতে পারেন নি। তিনি বলতেন, “একে আমরা তাঁর ব্যক্তিগত মত গণ্য করি। যেমন ওয়াজে কবিতা পাঠের অস্বীকৃতিও তাঁর ব্যক্তিগত মতামত।” নবী করিম স. এর হাদীস সমূহ পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, নামাযের পর দোয়া করা হাদিসে কাওলী ও ফেলি তথা তাঁর মৌখিক বক্তব্য ও কৃতকার্য দ্বারা প্রমাণিত। আর সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কে উৎসাহ হাদীস শরীফে এসেছে। সালাতুল কুসুফ তথা সূর্য গ্রহণের নামায দ্বারা এ সম্মিলিত মুনাজাত প্রমাণিত। সুতরাং নবী স. সাহাবা ও তাবেয়ীনদের সর্বোত্তম যুগত্রয়ে এর কোন ভিাত্ত নেই একে অসার বিদআত আখ্যায়িত করা যায়না। যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আল্লামা সাইয়েদ মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরী রহ, তিরমিযি শরীফের বিখ্যাত ব্যাখা গ্রন্থ মাআরিফুস সুনান এ নামাযের পর মুনাজাত করাকে সুন্নাত প্রমাণিত করেছেন। আমরা এর আগে উল্লেখ করেছি যে, কোন জিনিস সুন্নাত প্রমাণিত হওয়ার জন্যে সমাগ্রিক ভাবে তার প্রত্যেক অংশ প্রমাণিত হওয়া অত্যবশ্যকীয় নয়। হযরত মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব রহ. যুক্তি দেখাতেন যদিও নামাযের পর দোয়া করা এবং দোয়ার জন্যে হাত উঠানো এবং সূর্যগ্রহণের নামাযে সম্মিলিত মুনাজাতের প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু এমন একটি হাদীস উপস্থাপনা করো যার মধ্যে ফরয নামাজের পরে সম্মিলিত মুনাজাতের প্রমাণ মিলে। পটিয়ার হযরত মুফতী আযীযুল হক সাহেব রহ. এর জিবদ্দশায় এ বিষয়ে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পরই এ মাসআলার উদ্ভব হয়। ধীরে ধীরে উভয় বুজুর্গের শিষ্য শাগরেদ ও ভক্ত মুরিদানদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং উভয় পক্ষ সীমালঙ্গন করে চলছে।
আমার নগণ্য ধারণা মতে সরবে হোক কিংবা নীরবে সম্মিলিত মুনাজাত করাও জায়েয হবে। কেননা সম্মিলিত মুনাজাতের প্রত্যেক অংশের প্রমাণ হাদীস শরীফে পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ যদি তা অত্যবশ্যকীয় বা নামাযের অংশ মনে করে তাহলেই বিদআত হবে। মুনাজাতকে অত্যবশ্যকীয় ভাবার আশংকায় কেউ যদি মাঝে মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন তাহলে দোষের কিছু নয়।
হারামাইন শরীফাইন তথা মক্কা মদীনা ও অধিকাংশ আরবদেও প্রক্রিয়া এরকমই। তেমনি কোথাও যদি মুনাজাত করার নিয়ম চালু থাকে তাহলে তাও অস্বীকার করার মতো নয়। যেমন দেওবন্দ ও সাহারানপুরের পূর্বতন ওলামায়ে কেরাম থেকে শুরু করে সমসাময়িক ওলামা মাশায়েখগণ মুনাজাত প্রক্রিয়াই চালু রেখেছেন। তাই মুনাজাতকে একটি বিতর্কিক বিষয় বানানোর কোন প্রয়োজন ছিলোনা। কেননা এটা এমন কোন বিষয় নয় যে, ফরয নামাযের পর মুনাজাত করলে দ্বীনের পরিবর্তন ঘটবে বা তা একেবারে উঠিয়ে দিলে শরীয়তের কোন ক্ষতি হবে। (অধম লিখিত)
মতবিরোধ নিরসনের পরামর্শ:
বিতর্কিত বিষয়াবলী সম্পর্কে পটিয়ার হযরত মুফতী আযীয রহ. এর ভ‚মিকা ছিল প্রতিরক্ষামূলক। দ্ব›দ্ব ও তর্কমূলক ছিলো না। কখনো যদি তাঁর মত পথের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ হতো বা কেউ খুব বেশি বাড়াবাড়ি করতো তাহলেই তিনি মুখ খুলতেন বা কলমের আশ্রয় নিতেন। তিনি স্বভাবগত প্রবৃত্তি অগ্রজ বুজুর্গদের প্রতি অতিমাত্রার সম্মান প্রদর্শনের কারণেই মতবিরোধে নারাজ ছিলেন। কখনো কখনো আক্ষেপের সুরে বলতেন, হে আল্লাহ! আমি ও আমার অগ্রজদের মধ্যে মতবিরোধ কেন? আমার কপাল এমন কেনো? অনুরূপ দুনিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকার কারণে তিনি এ মর্মে খুব বেশি আফসোস করতেন যে, মানুষ বড় বড় ফিতনা ফাসাদের নিরসন না করে কেনো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে মতবিরোধের সৃষ্টি করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিশৃংখলা বিস্তার করছে? তিনি এ বিষয়ে ‘আফজালুল আমাল’ পুস্তকে বলেন, “অশান্ত পরিস্থিতিতে যখন একদিকে কাদিয়ানী ও খাকসারী সমস্যা দুরারোগ্য ব্যধির ন্যায় দৃশ্যমান হচ্ছে অন্যদিকে বাধ্যতামূলক আধুনিক শিক্ষার আশঙ্কাজনক ভবিষ্যতের ভয়ে হৃদয় টুকরো টুকরো হচ্ছে এবং খোদাদ্রোহ ও ধর্ম বিরোধের বিষক্রিয়া সারা মুসলিম বিশ্বকে বিষাক্ত করে তুলেছে। এমনি এক গোলযোগপূর্ণ যুগে যখন “আহলে হক”-এর কাফেলাকে সুসংগঠিত হয়ে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের রজ্জু দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরার প্রয়োজন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়াবলীতে মতবিরোধ সৃষ্টি করে এবং আরো কিছু নতুন ফিতনা উসকিয়ে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে ফেলা একেবারে অযৌক্তিক ও জাতির মঙ্গলকামী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের পরীপন্থী।”
اللهم أرناالحق حقا وارزقنا اتباعه
(সংক্ষিপ্তাকারে ‘আফজালুল আমাল’ থেকে)
বাস্তবধর্মী চিন্তাধারা :
আল্লাহ তাআলা হযরত মুফতী আযীয রহ. কে সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সু²াতিসু² তথ্য উদঘাটনের আশ্চর্য শক্তি দান করেছিলেন। যে কোন ব্যপারে তাঁর দৃষ্টি হতো খুবই তী² । শাস্ত্রিয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেক অধ্যায়ে তাঁর সত্যনুসন্ধানী দীপ্তি পরিলক্ষিত হতো। ছাত্ররা তাঁর দরসে অশুদ্ধ মতন (রীডিং) পড়ার অবকাশ পেতো না। বিশেষত হাদীসের কিতাব পড়ানোর সময় হাদীস বর্ণনাকারীর নাম অশুদ্ধ পড়লেও ধরতেন। যেসব শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকের তত্ত¡াবধানে তিনি শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করেছিলেন, তাদের অধ্যাপনা পদ্ধতিও অনুরূপ বাস্তবধর্মী ছিলো এটা তাদের শিক্ষা দীক্ষা ও সংশ্রবেরই স্বভাবিক ফল। তাঁর ¯েœহময় স্বনামধন্য মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব রহ. দাওরা শরীফের (হাদীস গ্রন্থাবলির ) দরস সমাপনী অনুষ্ঠানে পটিয়ায় তাশরীফ এনেছিলেন। তখন লেখকও হাদীস শরীফের একজন নগণ্য ছাত্র ছিলো। অভিভাষণের এক পর্যায়ে হযরত মুহাদ্দিস সাহেব রহ. এক আশ্চর্য কথা বলে ফেললেন যে, বর্ণনাকারীর নাম অশুদ্ধ বলাকেও কেউ কেউ হাদীস শরীফের মর্মার্থে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। হাদীসের মর্মার্থ হচ্ছে ; যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার হাদীসে মিথ্যা বলবে, মে নিঃসন্দেহে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
অর্থাৎ- বর্ণনাকারীর নাম অশুদ্ধ বলাও হাদীসে রাসূলে মিথ্যা ঢুকানো। এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা চায়। হযরত হাম্মাদের দরস থেকে ‘সিবওয়াইহ’ কে পেশের স্থলে যবর পড়েছিলেন বলেই বের করে দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ- رُويفع কে رَويفع পড়েছিলেন। হযরত হাম্মাদ সাথে সাথে বলে দিলেন, তুমি হাদীসের উপযোগী নও। সত্যিই সিবওয়াইহ আরবী ব্যাকরণের সর্বশ্রেষ্ঠ ইমাম হলেও হাদীসের এলম থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। হযরত মুফতী আযীয রহ. শরীয়তের মাসআলা মাসায়েল অনুসন্ধান ধর্মীয় পদ্ধতিতে নিরীক্ষণ করে দেখতেন। ফিক্হ এর কিতাবাদী উদ্ধৃতিমালা ও বিভিন্ন ফতওয়ার মধ্যে পারস্পরিক তুলনা করে দেখতেন। কোথাও তাঁর সংশয় হলে হিন্দুস্থানের সর্বজন স্বীকৃত মুফতী ও বিশ্বস্ত আলেমগণের শরণাপন্ন হতেন। তাঁর এ তথ্যনুসন্ধানী প্রক্রিয়া আলেম সমাজে ও শিক্ষিত মহলে বিরাট প্রভাব ফেলেছিলো। তাঁর ফতওয়ায় ওলামা সমাজ সন্তোষ লাভ করতেন। যে সব মাসআলায় আহলে হক এর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে । সে সব মাসাআলায় তাঁর মতামত ওলামা সমাজ পরিতৃপ্ত চিত্তে মেনে নিতেন। আর এটাই তো ‘মুহাক্কেক” তথা সত্যনুসন্ধানী হওয়ার প্রমাণ। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. বলেন, মুহাক্কেক হওয়ার এটাও একটি প্রমাণ যে, তার কথায় মনে প্রশান্তি ও স্থিতি আসে।” (কামালাতে আশরাফিয়া পৃঃ ৩১)
ইলমুল ফারায়েজ (উত্তরাধিকার সাস্ত্র):
ইলমুল ফারায়েজে তিনি খুবই দক্ষ ছিলেন। এ শাস্ত্রে এমন সহজ ও সরল পন্থায় পাঠদান করতেন যে, যেকোন পর্যায়ের ছাত্ররা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলতো। তিনি ফরায়েজের কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন-نعم العروض فى نظم الفروض নামী ফরায়েজের আরবী কাব্যগ্রন্থ তাঁর এক অলৌকিক কীর্তি। ফরায়েজের মতো জটিল শাস্ত্রকে আরবী কাব্যে এমনভাবে রচনা করেছেন যে, তার ছন্দ ও পংক্তির কোথাও লক্ষ্যচ্যুতি হয় নি। ভাষার নান্দিকতা ও স্বচ্ছতা ও ব্যাতিক্রম ঘটেনি, আর বর্ণনাশৈলীও এতো সহজ যে, অনায়াসে একটি সাগরকে যেনো একটি ক্ষুদ্র পাত্রে ভরে দেওয়া হয়েছে। এ শাস্ত্রের ছাত্ররা প্রচলিত ফরায়েযের অন্যন্য কিতাবাদীর প্রত্যেক অধ্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কবিতাগুলো মুখস্থ করে নিলে সহজেই প্রত্যেক মাসআলা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।
মাওলানা রূমির মছনবীর সাথে সম্পর্ক:
মোল্লা রূমী র. এর মছনবীর সাথেও তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিলো। একে তো মছনবী শরীফ মারেফাতের অমূল্য ভান্ডার এবং আল্লাহ প্রেমের বিশাল বিস্তৃত গ্রন্থ হওয়ার কারণেই ছিল এ সম্পর্ক। দ্বিতীয়ত উদাহরণ ও দৃষ্টান্তের মাধ্যমে স্বীয় দাবি উপস্থাপনা করা তাঁর বিশেষ রুচিভ‚ক্ত ছিলো। আর মোল্লা রূমীও ছিলেন উদাহরণ জগতের স¤্রাট। এ কারণেও মছনবীর সাথে তাঁর আন্তরীক টান ছিল স্বাভাবিক। মাওলানা রূমীর পাঠ ও পাঠদানের নিয়ম তরীকত জগতের পীর মাশায়েখেদের মধ্যে পূর্ব থেকেই চলে আসছে। হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিওে মক্কী রহ. তো একথাই বলতেন যে, “চলো ভাই একটু মছনবী তেলাওয়াত করে নিই।” হাকীমুল উম্মাত মাওলানা থানভী রহ. কলীদে মছনবীর স্থানে কবিতার সারমর্ম ও তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে হাজী এমদাদুল্লাহ রহ. এর উদ্ধৃতি টেনেছেন। আর লিখেছেন আমার মুরশিদ এরকমই বলেছেন। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো যে, থানভীর জন্যে কারো উদ্ধৃতি টানার কী প্রয়োজন ছিলো? এটা কুরআনের তাফসীর কিংবা কোন কোন হাদীসের ব্যাখ্যা তো নয়। এতে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, ফার্সি ভাষা ও পরিভাষা জানার দ্বারা মছনবী বুঝতে পারা যায় না; মছনবী বুঝতে হলে বুজুর্গদের সোহবত দরকার। মছনবীর অন্তর্নিহিত ভাব ও তাৎপর্য আল্লাহর কোন আরেফের কাছ থেকেই জেনে নেওয়া প্রয়োজন। এ জ্ঞান “সীনা বসীনা” অর্থাৎ এক বুক থেকে অপর বুকে সম্প্রসারিত হয়।
হযরত মুফতী সাহেব রহ. পটিয়া মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস তথা শিক্ষা সমাপনী বর্ষের ছাত্রদেরকে মছনবীর দরস দিতেন। এসব দরসে ছাত্ররা ছাড়া ওলামায়ে কেরাম এবং সালেকিনরাও (তরীকতের যাত্রি) বসতেন। দাওরায়ে হাদীসের বছর আমাদেরও উক্ত দরস থেকে উপকৃত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয়েছিলো।
হযরত মুফতী সাহেব রহ. প্রথমে অত্যন্ত ব্যথা ভরা হৃদয়ে মছনবীর দু’চারটি কবিতা সুর দিয়ে পড়তেন। অতঃপর সেগুলোর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতেন। তাঁর সে সব বক্তব্য অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের মারেফাতপূর্ণ ও গবেষণামূলক হতো। আমাদের তা হৃদয়ঙ্গম করার কথা নয়। তবে এতটুকু মনে পড়ে যে, তাঁ মছনবী পাঠের ধরণ ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর। মনের মধ্যে তার গভীর প্রভাব পড়তো। এমন মনে হয় যে, নি¤েœর কবিতাসমূহ তাঁর সুর করে পাঠ করার এখনো শুনতে পাচ্ছি-
نے حدیث راہ پر خوں می کند + قصہائے عشق مجنوں می کند
نے حریفے ہرکہ از یارے برید + پردہایش پردہائے ما درید
“আর কখনো কখনো তিনি এদিক সেদিক তাকিয়ে বলতেন কাকে বলবো, এমন মনে হচ্ছে যে, বুঝার মতো কেউ নেই।”
মুফতী সাহেব রহ. এর মছনবীর দরসে বসার কারণে আমাদের মতো অযোগ্যদের উপরও অজ্ঞাতসারে এ প্রভাব পড়ে যে, মছনবীর সাথে আমাদেরও সামান্য সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে এ তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে হযরত মাওলানা মুহাম্মদ হারুন বাবুনগরী রহ. এর সামনে মছনবী নিয়ে ছাত্র হিসেবে বসে পড়ি। তিনি একটি মাত্র ছবক পড়িয়ে দোয়া করে দেন। নিজেকে অপরিচ্ছন্ন অন্তর ও অযোগ্যতার কারণে কিছুতো অর্জিত হয়নি ; কিন্তু তারপরেও বাস্তবতা এই যে,
مستی کے لئے جامے مئ تند ہے کافی+ مئ خانہ کا محروم بھی محروم نہیں ہے
“নেশার জন্যে সতেজ মদের পাত্রও যথেষ্ট, শরাবখানার বঞ্চিতও বঞ্চিত নয়।”
মুফতী সাহেব রহ.-এর বিশিষ্ট ছাত্রবৃন্দ:
তাঁর শিক্ষা ও দীক্ষাদানে ইসলামী জ্ঞানের শিক্ষার্থীরা কতই যে উপকৃত হয়েছিলো তা অনুমান করার নিমিত্তে দু চার জন ছাত্রকে দেখাই যথেষ্ট। হিন্দুস্থান থেকে প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই তিনি জিরি মাদরাসার শিক্ষক নিযুক্ত হন। যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। চৌদ্দ পনের বছর পর্যন্ত অতি সুন্দর ও সুশোভিত পন্থায় অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। আপন শিক্ষকমন্ডলীর কাছ থেকে ইলমের যে ভান্ডার সঞ্চার করেছিলেন তা তাঁর ছাত্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার এক শক্তিশালী উদ্যাম তাঁর মাঝে তৎপর ছিলো। যার ফলশ্রæতিতে বহু ছাত্র তাঁর রূপে রূপায়িত হয়েছেন ও বিভিন্ন শাস্ত্রে তাঁর মডেলে পরিণত হয়েছিলেন। প্রথম যুগে তথা তাঁর শিক্ষাজীবনের যৌবনে যে সব ওলামা তাঁর কাছে শিক্ষা লাভ করে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ইলমের উল্লেখযোগ্য খেদমত করেছেন বা করে যাচ্ছেন সেসব ওলামার মধ্য হতে বিশিষ্ট কয়েকজনের নাম নিম্নে প্রদত্ত হলো:
(১) আল্লামা মাওলানা আহমদ সাহেব (প্রকাশ ইমাম সাহেব হুজুর) রহ. (মৃত্যু-১৪১০ হি.)। শায়খুল হাদীস, জামিয়া পটিয়া।
(২) আল্লামা আমীর হুসাইন ( মীর সাহেব) রহ. মৃত্যু ১৪০৪ হি.। শায়খুল হাদীস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(৩) আল্লামা মুফতী নূরুল হক সাহেব রহ. (মৃত্যু-১৪০৮ হি.)। মুহাদ্দিস ও মুফতী এবং মুহতামিম, জামিয়া আরবিয়া জিরি।
(৪) প্রখ্যাত সাহিত্যিক আল্লামা আলী আহমদ খীরী রহ.। সাহিত্য বিভাগীয় প্রধান ও অন্যতম মুহাদ্দিস, জামিয়া পটিয়া।
(৫) আল্লামা মাসউদুল হক সাহেব রহ.। মুহাদ্দিস, জামিয়া মোজাহেরুল উলূম, চট্টগ্রাম। মৃত্যু-১৪০৫ হি.।
(৬) আল্লামা মুহাম্মদ ইসহাক গাজী রহ.। শায়খুল হাদীস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(৭) আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ ইব্রাহিম রহ. (মৃত্যু-১৪০০ হি.)। প্রধান মুফতী, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(৮) হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আলী রহ. মৃত্যু ১৪০৪ হি.। শিক্ষক, দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী।
(৯) হযরত মাওলানা মুহাম্মদ দানেশ সাহেব শহীদ মৃত্যু-১৩৯০ হি.। মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(১০) হযরত মুহাদ্দিস মাওলানা সাঈদ আহমদ গহিরাভী রহ.। শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(১১) হযরত মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস মুহাজেরে মাদানী রহ. (মৃত্যু : ১৩৯৬ হিজরি)। জান্নাতুল বকীতে দাফন করা হয়।
(১২) হযরত আলহাজ মাওলানা আলী আহমদ সাহেব রহ. (মৃত্যু ১৪১৩ হি.) মুহতামিম,বোয়ালিয়া নতুন মাদরাসা।
(১৩) মাওলানা আলী আহমদ সাহেব বোয়ালভী রহ. (১৪২৪ হি)। মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(১৪) হযরত মাওলানা নুরুল ইসলাম কদীম রহ., মুহাদ্দিস ও মুহতামিম, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(১৫) জনাব মাওলানা কাজী আবুল খাইর শামসী সাহেব (কৈয়গাম)।…
(১৬) মাওলানা সালেহ আহমদ সাহেব রহ. (মৃত্যু : ১৯৭১ ইং)। মুহতামিম, জামিয়া মোজাহেরুল উলূম, চট্টগ্রাম।
(১৭) মাওলানা বদিউর রহমান সাহেব রাউজানী রহ. (মৃত্যু : ১৪০৬ হি.)। শিক্ষক, মহেশখালী ঝাপুয়া মাদরাসা।
(১৮) মাওলানা আনোয়ারুল আজিম সাহেব রহ., মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(১৯) মাওলানা মুহাম্মদ লেকমান আরকানী। মৃত: ১২/০১/১৪২৭ হি.। শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(২০) ড. মাওলানা মুহাম্মদ রশিদ (মুহাম্মদপুর পটিয়া) (মৃত্যু : ২০২১ইং)।
(২১) জনাব মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ (নোয়াখালী) মৃত্যু ১৩/১১/২৮ হি.। মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(২২) জনাব মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। মুহতামিম, জামিয়া আযীযুল উলূম বাবুনগর।
(২৩) আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী । প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রাম।
(২৪) মাওলানা মুফতী মুজাফ্ফর আহমদ রহ. (২০১৭ইং) মুফতী ও মুহাদ্দিস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
(২৫) মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রহ. মৃত্যু : ১৪২৪হি.। মুহতামিম, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।
জিরি মাদরাসা থেকে অব্যহতি গ্রহণ ও জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ:
১৩৪৫ হিজরীর শাবান মাসে হযরত মুফতী সাহেব রহ. ভারত সফর দেশে ফেরার থেকে ১৩৫৯ পর্যন্ত এক নাগাড়ে তের-চৌদ্ধ বছর যাবত জিরি আল জামিয়াতুল আরবিয়া আল ইসলামিয়া মাদরাসার শিক্ষক ও মুফতী হিসেবে নিয়েজিত থাকেন। ১৩৫৭ হিজরির মাঝামাঝি সময়ে আপন শায়খ রহ. জিরি মাদরাসা ছেড়ে পটিয়ায় আরেকটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেন। কিন্তু জিরি মাদরাসার মুরব্বিগণ কোনমতেই রাজি না হওয়ায় এভাবে আরো দুবছর কেটে যায়। অবশেষ শায়খের পরামর্শকেই তিনি প্রধান্য দিলেন এবং ১৩৫৯ হিজরিতে পটিয়ায় পরোক্ষভাবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কাজ করে দেখা শোনা করতে লাগলেন। সে বৎসর জুমাদাল উলা মাসে শায়খের ইন্তেকালের পর শাওয়াল মাসে হযরত মুফতী সাহবে হুজুর রহ. প্রত্যক্ষভাবে পটিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। জিরি মাদরাসার সকল মুরব্বি বিশেষত শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল ওয়াদুদ সন্দিপী রহ. ও মাদরাসার মুহতারাম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হযরত মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব রহ. সাথে মুফতী সাহেব রহ. এর অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক ছিল। তারাও হুজুরকে মায়াভরা সুনজরে দেখতেন। এ দিকে জিরি ও তার আশেপাশের এলাকায় হুজুরের প্রবল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সঙ্গত কারণে কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি যে, হযরত মুফতী সাহেব রহ. জিরি মাদরাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবেন। যেহেতু জিরি মাদরাসাতে লেখাপড়ার পর সেখানেই দীর্ঘকাল সাগ্রহে স্বাচ্ছন্দে মনের মাধরী মিশিয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ফলে তার স্বভাব ও মন মানসিকতা জিরির পরিবেশের সাথে অনেকটা একাকার হয়ে গিয়েছিল। মাদরাসার প্রতিটি ধুলিকণার সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতা উঠেছিল। জনৈক কবি বলেছেন,
مقام امن ومئے بے غش ورفیق شفیق + گرت مدم میسر شود زہے توفیق
অর্থ: যদিও কোথাও গিয়ে নিরাপদ স্থান নির্ভেজাল শরাব এবং মমতাময় সাথি পাওয়া যায় তাহলে এমন মনোরম পরিবেশকে আল্লাহর পক্ষ থেকে তৌফিক মনে করতে হবে।
এককিছুর পর ও জিরির পরম অনুক‚ল পরিবেশ ছেড়ে পটিয়ার মতো কঠিন মরুময় ও ভয়ানক এলাকায় তিনি পাড়ি জমালেন। কিন্তু কেন? এানুষ তো কখনো চায়না তার পরিবেশটা প্রতিক‚ল হোক।জীবন যাত্রা কষ্টের হোক। কিন্তু প্রেম ভালোবাসা যখন মনের মনিকোঠা জয় করে নেয় তখন কোন উজর আপত্তি কিংবা স্বার্থ-সুযোগের তোয়াক্কা করা চলেনা। হাফেজ শিরাজী রহ. বলেন,
بمئی سجادہ رنگیں کن گرت پیر مغاں گوید + کہ سالک بے خبر نبود ز راہ رسم منزلہا
অভিজ্ঞ পীর যদি আদেশ করে থাকে তবে শরাব ঢেলে তোমার মুসল্লা রঞ্জিত করে ফেল। কেননা, পথিকের কাছে তার মনযিলে মাকসুদেও পথ চিহ্ণ অজানা থাকেনা।তেমনি শায়খের প্রেম ভালবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা যেহেতু হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর হৃদয় মন জয় করে নিয়েছিলো সেহেতু শায়খের ইঙ্গিতের পর সেখানে নিজের কোন বিবেচনার অবকাশ ছিলো না। তাই তিনি কোন উজর আপত্তি ছাড়াই নিজের প্রাণ প্রিয় প্রতিষ্ঠান জিরি মাদরাসা ত্যাগ করেন।
পটিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানও ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে তা শিরক বিদআতের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো। বর্তমান পটিয়া মাদরাসা সংলগ্ণ রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর দক্ষিণ দুদিকে এক কিলোমিটারের ব্যবধানে দুটি মাজার আর পূর্বদিকে দু/এক কিলোমিটারের মধ্যে আরো একটি মাজার রয়েছে। এসব মাজার কবর পুজা ও গায়রুল্লাহর কাছে প্রার্থনা অর্চনার কেন্দ্রের ভ‚মিকা পালন কওে আসছে। অপরদিকে ধর্মহীন ইংরেজী আধুনিক শিক্ষা অত্র এলাকায় এত বিস্তার লাভ করে যে, পাশাপাশি দুইটি হাইস্কুল পুরোদমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর এ স্কুলদ্বয়ের পথ ধরে পরবর্তীতে একটি কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিক‚ল কারণেই হয়তো হযরত মুফতী সাহেব রহ. এ এলাকায় একটি সঠিক দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি সেখানকার দ্বীনদার ও দাওয়াতের কাজের সাথে জড়িত আলমদেও সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শও করেন। অবশেষে শায়খের মুখ থেকে একটি অদ্ভুত প্রশ্ন ভেসে আসলো। আযীয! তুমি কি জিরি থেকে আলাদা হতে পারো? উত্তরে হযরত মুফতী সাহেব রহ. নিজের প্রাণ প্রিয় প্রতিষ্ঠান ত্যাগের প্রস্তাবে কোন প্রকার অজুহাত না দেখিয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তবে তার মনে কিছুটা অসন্তুষ্টির ভাব জন্মেছিলো এ জন্য যে, শায়খ তাকে সরাসরি আদেশ না দিয়ে মতামত জানতে চেয়েছেন। তাই তিনি শায়খ কে বললেন: হযরত আপনার প্রশ্নে মনে হচ্ছে যেন আমার প্রতি তেমন আস্থা নেই। এভাবে মতামত জানতে না চেয়ে সরাসরি আদেশ দিলে বরং ভাল লাগবে। কেননা আমার অবস্থঅ এখনও এ পর্যায়ে যে , হযরতের ইশারা বা আদেশ হলে আমার প্রিয়তমা স্ত্রিকে তালাক দিতেও দ্বিধাবোধ করবো না।
সারকথা, এদুটি বিষয়ই ছিলো- শায়খের ইশারা ইঙ্গিত ও এলাকার গুরুত্ত। এ কথা বলা কঠিন যে, এর সাথে অন্য কোন কারণ ছিল বি ছিলনা। তবে শায়খের হাতে বাইয়াত হবার যিক্র আজকার ও অজিফার যে বান ডেকেছিল, যখন স্বীয় মুর্শিদ ও পীরের মার্যাদার কারণে তার ব্যক্তিত্বেও দ্রæত বিকাশ ঘটছিলো। ভেতর ও বাইরে তার গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন তরীকতের যিক্র আযকার সম্পর্কে কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও কানাঘুষা শুরু হবার কথা জানা যায়। এত অনুমান করা যায় যে, রুচির ভিন্নতা ও কোন কোন সমসাময়িক সহকর্মিদের সাথে ব্যক্তিত্বেও দ্বন্ধের কারণেও তিনি মোটামুটি মন তুলে ফেলেছিলেন।
শায়খুল মাশায়েখ হযরত মাওলানা জমীরুদ্দিন রহ. ঝঞ্চাটমুক্ত নিবিড় পরিবেশে হাজারো জ্ঞান পিপাসুর পিপাসা নিারণ এবং শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে সংস্কার কার্যে নিবেদিত প্রাণ একজন শিষ্যকে হঠাৎ কেন স্থঅন পরিবর্তনের নির্দেশ দিলেন। তা অবশ্যই কোন মহৎ লক্ষ্য কে সামনে রেখেই হবে। মনেহয়, জিরিতে শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ও মুরব্বিগণের ভিড়ে হযরত মুফতী সাহেব রহ. এর ফয়েজ বরকত হয়ত প্রকাশ পেতে পারেনি। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তা প্রকাশের ইচ্ছা করলেন। পটিয়ার কলুষিত পরিবেশে তার আলোয় প্রোজ্জল হবে। তথা বাংলাদেশ ও বার্মার ঘরে ঘরে তার ফয়েজ বরকত পৌছে যাবে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এমনফায়সালা হবার কারণে শায়খ তাকে জিরি ত্যাগ কওে পটিয়া যাওয়ার আদেশ দেন। জিরির শ্রদ্ধাভাজন মুরব্বিগণ ও চরম অনিচ্ছা সত্তেও শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে গুরুত্পূর্ণ পরামর্শ দিয়েও তাকে সার্বিকভাবে সহযেগিতা করে যান। যাই হোক, বাহ্যত যে কারণেই পটিয় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করুক না কেন প্রকৃত পক্ষে সবই মহামহিম আল্লাহ পাকের হিকমত ও কারিশমা বৈ কিছু নয়। কবি বলেন,
کار زلف تست مشک افشانی اما عاشقاں + مصلحت را تہمتے بر آہوئے چیں بستہ اند
অর্থ: মুমের সুবান বিতরণ আসলে তোমার জলপিরই কাজ। কিন্তু প্রেমিকগণ তাদের সার্থে হরিণে মির্গ নাভির নামে অপবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠাতার ভাষায় জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া প্রাথমিক ইতিহাস :
হযরত মুফতী সাহেব রহ. (প্রতিষ্ঠাত ও প্রথম পরিচালক) পটিয়া মাদরাসার মূল ইতিহাস নিজ ভাষায় লিখিয়েছেন। যা রেকর্ড বইতে সংরক্ষিত আছে। এটি হযরতের খাস খলিফা ও প্রাইভেট সেক্রেটারি হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ সাহেব রহ. এর কলমে লিখিত। এর নির্বাচিত অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো।
পটিয়া এবং তার ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা:
চট্টগ্রাম জেলার মধ্যবর্তী স্থানে পটিয়া এক প্রসিদ্ধ থান শহর যা সুপ্রশস্ত আয়তন ঘনবসতি তদুপরি সরকারি কোটকাচারী তথা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দরুণ বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। তার উপর আধুনিক ইংরেজী শিক্ষার বিরাট প্রভাব রয়েছে। শহরের কেন্দ্রস্থলেই দুটি উচ্চ বিদ্যালয় কাছাকাছি অবস্থিত। প্রায় চার মাইল দুরত্বেও মধে প্রসিদ্ধ এক ডিগ্রি কলেজ। (আর এখন তো সেসব স্কুলের পাশেই পটিয়া ডিগ্রি কলেজ। এখানে নামে মাত্রও কোন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা। অথচ এখানকার লোকজন সহিহ ইসলাম সম্পক্যে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, কুপ্রথা ও বিদআতের শিকার এবং শিরক ও কবর পুজার ব্যধিতে আক্রান্ত ছিলো। বাতিল পন্থি ভ্রষ্ট তথাকথিত সুফিরাই এখানকার নিরহ ও মুখ জনগণের একান্ত অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ।এমনকি পটিয়া শহরে পূর্ব দিকে এমন তিনটি কবর রয়েছে । যে গুলোতে মৃত ব্যক্তিদেরকে পুর্ব দিকে মাথা নিচের দিকে করে জানাযার নামায ছাড়াই উলঙ্গাবস্থায় নাচ গান ও বাদ্য বাজনা সহকারে মাটি চাপা দেওয়া হয়। এক কথায় , এখানকার ধর্মীয় অবস্থা অবনতির চরম সীমায় নিপতিত হয়েছিলো।
বড়দের দুআর ও তাঁদের মৃত্যুর পর সফল হওয়া :
যে সকল আকাবিরকে আল্লাহ রাব্বুল আমিন বাংলার বুকে প্রিয় নবী স. এর সুন্নকে পূর্নজীবিত করণ, শিরক বিদআতকে মাটিতে পুতে ফেলার এবং দ্বীনি শিক্ষা ও বিশুদ্ধ তাসাওফের (সুফিতত্ব) প্রচার প্রসারের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন; যারা নিজেদের নিষ্ঠা খোদাভক্তি ও আত্মোৎসর্গের দ্বারা এখানে হেদায়াতের ছড়িয়েছেন, তাঁদের একান্ত কামনা-বাসনা ছিলো যে, পটিয়াতে দ্বীনি শিক্ষার একটি কেন্দ্র প্রতিাষ্ঠত হোক। আর আমাদের পূর্ব পুরুষগণ এমন ছিলেন যে, তাদের দ্বারা বহু জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তাদের দ্বারা এমন বহু মহৎ কাজ সম্পাদিত হয়েছে যেগুলো অলৌকিক ও কারামাত নামে অবহিত করার যোগ্য ছিল। কিন্তু তাদের হাতে পটিয়াতে কোন শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং সেখানকার লোকজন তাদের দ্বারা হেদায়াত প্রাপাত হওয়া বোধ হয় বিশ্বপ্রভুর ইচ্ছা ছিলনা। তাদের শিষ্য শাগরিদের ভাগ্যেই তা লেখা ছিলো। ফলে সেসব মহা পুরুষের জীবদ্দশায় তাদের আশা সফল হয়নি। এলাকার মুরুব্বি গোচরের অনেকের দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে যান। হঠাৎ করে হযরত মাওলানা জমিরুদ্দিন রহ. যাকে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের মধ্যে অলিকুল শিরোমণি গণ্য করা হতো। শেষ বয়সে অধম বান্দাহ আযীযুল হককে পটিয়াাতে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্যে মনযোগী করে তুললেন এবং হযরতের বিশেষ খলীফা মাওলানা ইসকান্দার সাহেব রহ. কেও এ কার্যে শামিল হওয়ার জন্য ইঙ্গিত দেন।
শায়খুল মাশায়েখের নির্দেশ ও তার সফল বাস্তবায়ন:
এক সাক্ষাতকালে কুতুবুল আকতাব হযরত মাওলানা জমীরুদ্দিন সাহেব রহ. চট্টগ্রাম শহরে অধম আযীযুল হককে বলেন, “তুমি কি জিরি মাদরাসা থেকে পৃথক হকে পারবে?” আম দ্বিধাহীন চিত্তে তার এ ফরমান গ্রহণ কওে নিলাম । জিরি থেকে পৃথক হওয়া মানে পটিয়াতে মাদরাসা প্রসিষ্ঠার প্রতি ইঙ্গিত ছিলো।) হযরতের এ ইশারা ১৩৫৭ হিজরির মধ্যভাগে ছিলো। অধম রমজানের আঠারো দিন পূর্বে ইস্তিখারা করে ইস্তিফানামা পেশ করি। ইস্তিফানামা পেশ করার সময় জিরি থেকে পৃথক হওয়ার মধে আত্মিক স্থিরতা ও প্রশান্তি অনুভব হচ্ছিলো। মনে হয় ভবিষ্যতের কোন কর্মসূচির ব্যাপারে সারা জীবনই সারা জীবনেই এ রূপ শান্তি অনুভূত হয়নি। ইস্তিখারা করার সময় আমি অন্তরকে জিরি মাদরাসা থেকে পৃথক হওয়া এবং পটিয়াতে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগী করেছিলাম। ইস্তিখারার নির্ধারিত নিয়ম পালন করে ঘুমিয়ে পড়লে দেখতে পাই যে, স্বপ্নে আমাকে কে যেন বলছিলো وعلى الله فليتوكل المتوكلونমুমিনদের আল্লাহর উপরেই নির্ভর করা উচিত। চোখ খুললেই খুব রূহানী তৃপ্তি অনুভ‚ত হলো। ১৩৫৭ হিজরি সনের মাহে রমজানের শুরুতে চট্টগ্রাম শহরে হযরতের সাথে আমি এবং মাওলানা ইস্কান্দার সাহেব সে বিষয়ে আলোচনার জন্য বসি। কিন্তু সেদিন আমরা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। আবার ১৭ ই রমযান জামায়েত হওয়ার দিন ঠিক হলো। অধম নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হয়। অধিক বৃষ্টির দরূণ তারা উভয়েই আসতে পারলেননা। আমি দু একদিন অপেক্ষা করে এতেকাফের জন্য বাড়ি ফিরে যাই। ঈদেও নামাযের পর আধ্যাত্মি পিতা ও মুরব্বি জিরি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিজালক হযরত মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব রহ. আমার বাড়িতে তাশরীফ আনয়ন করলেন এবং আমাকে জিরি মাদরাসায় চাকুরি বহাল রাখার জন্য বাধ্য করলেন। সুতরাং আমার ইস্তিফা নামা গ্রহন করা হয়নি। ফলে দু বছর জিরিতে থাকতে হলো। তবে ১৩৫৭ হিজরিতে জিরি মাদরাসার শিক্ষকতার কাজে বহাল থেকে পটিয়া মাদরাসার কাজ আরম্ভ করে দেওয়া হলো। মাওলানা আহমদ সাহেব, মাওলানা ঈসা সাহেব , মাওলানা আমজাদ সাহেব মাওলানা মুসলেম সাহেব রহ. কার্যক্ষেত্রে চেষ্টা করতে লাগলেন আর আমি এখান থেকৈই দেখা শুনা করি।
অধম ১৩৫৮ হিজরিতে হযরতের শেষ সফর পবিত্র হজে তার সফর সাথী হয়েছিল। হজ থেকে ফেরার পর এক বছর থেকে কিছু দিন বেশি আমরা তার ছায়াতলে থাকতে সক্ষম হয়। জুমাদাল উলা ১৩৫৯ হিজরীতে সকল শিষ্যদেরে কএতিম করে তিনি পরপাওে যাত্রা করেন। ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ১৩৫৭ হিজরিতে মাদরাসার যে ভিত্তি সস্থাপন করা হয় তা উন্নতি করতে পারলনা। বরং মাদরাসার অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখিন হয়। ১৩৫৯ হিজরীতে হযরতের মৃত্যুর পর পণরায় জিরি মাদরাসার চাকুরি ত্যাগ ও পটিয়া চলে যাবার ইচ্ছা পোষণ করি। ২৩ রাত অনবরত ইস্তিখারা করি। এ দীর্ঘ ইস্তিখারর অধিকাংশ সময় মহেশখালীতে কাটে। লেখক ও তার দেশবাসীর জন্যে এটি গৌরবের বিষয়) তেইশতম রাত্রে কে যেন আমাকে বলছেন ইতস্ততো করছো কেনো? যাও পথ সুগম হবে। কারো নাম নিয়ে বললেন যে নাম এখন আমার স্মরণ নেই। তুমি কি দেখছনা অমুক কাজ শুরু করেছেন ও পথ উম্মুক্ত পেয়েছেন। অতঃপর সেদিন সকালেই আমি পটিয়া উপস্থিত হওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা করলাম। তখন মাদরাসায় যে সব আলেম উপস্থিত ছিলেন। তাদেরকে আমার এ দৃঢ় অঙ্গিকার বা ইচ্ছা এক ছাত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দিই।
পটিয়ায় আমার উপস্থিতির পূর্বে:
১৩৫৭ হিজরীতে যখন জিরিতে অবস্থান কালীন সময়ে পটিয়ায় কাজ আরম্ভ করতে প্রস্তুত হই, (অধম আযীযুল হক) বিভিন্ন আলেমের সাথে পটিয়ায় কাজ শুরু করার কথা বললে কেউই ডাকে সাড়া দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করেননি। তাই আমার নিকট ব্যাপারটি অনেক জটিল মনে হতে লাগল।এ সময় সৌভাগ্যক্রমে মাওলানা আহমদ মোহরবীর সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তাকে বললাম আপনি পটিয়াতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রস্তুত হোন। অধমও সহযোগী হিসেবে কাজ করে যাবে। মৌলানা আহমদ সাহেব দ্বিধাহীন কন্ঠে বলে ফেলেলেন, আপনার নির্দেশ যেহেতু আমি এ খেদমতের জন্য প্রস্তুত, ইনশাআল্লাহ। অথচ তিনি পটিয়ার বাসিন্দা নন। সেখানকার লোকজনের সাথে তার পূর্ব কোন পরিচিতিও নেই। আর ওয়াজ নসিহত ও চাঁদা কালেকশনের ও তেমন অভ্যস্থ নন। এ হিসেবে পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যিনি অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছেন তিনি হলেন হযরত মাওলানা আহমদ সাহেব রহ. যিনি ইমাম সাহেব নামে খ্যাত। পটিয়া শহরের আড়াই মাইল দূরে মাওলানা ঈসা সাহেব নামে এক ভদ্র, বিশুদ্ধ আকিদাবান নওজোয়ান আলেম ছিলেন্ যিনি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিক্ত ছিলেন।তাতে এ কাজে শরিক হওয়ার জন্য দাওয়াত দিলাম। তিনিও সাদরে গ্রহণ করলেন এবং বললেন, আমি এ কাজেন জন্য প্রস্তুত এবং এক বছর বিনা বেতনে চাকুরী করব।আমার ঘরে মাওলানা আহমদ সাহেবের খানা-পিনার ব্যবস্থাও করবো। মাওলানা আহমদ সাহেব বললেন যদি আমার খানা-পিনার বন্দোবস্ত হয়ে যায়, তবে বেতনের কোন চিন্তা নেই। আমরা তিন জন মিলে মাওলানা হামীদুর রহমান সাহেবের কাছে পরামর্শের জন্য গেলাম। তিনি এলাকার একজন সুন্নাতের অনুসারী বায়েবৃদ্ধ আলেম। অন্য একজন শিক্ষানুরাগী, উলামা প্রিয় জাগ্রত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি মরহুম আমজু মুনশিকে ও পরামর্শে শরিক করা হলো।
মাদরাসার বর্তমান অবস্থান থেকে সামান্য দক্ষিণ পশ্চিমে পরির দীঘির পাড়ে তুফান আলী মুনশীর প্রভাবশালী গোষ্ঠি বসবাস করতো। মুনশী সাহেবের চেষ্টা ও তার গোষ্ঠির লোকদের সাহায্য সহযোগিতা দ্বারা সেখানে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আর আগামী জুমাবার তুফান আলী মুনশীর মসজিদে আলেম ও সালেহগণের এক জামায়েত হওয়া এবং এবং জুমার পর মাদরাসার প্রাথমিক কার্যক্রম পূর্ণরূপে শুরু হওয়ারও সিদ্ধান্ত হলো। সিদ্ধান্ত মতে সে জুমায় মান্যগণ্য আলেমদেরও কয়েকজন ছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন জিরি মাদরাসার পরিচালক মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব রহ. ও হাটহাজরিী মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব সাহেব রহ.। সকলেই উক্ত মসজিদেই একত্রিত হন। কিন্তু তুফান আলী মুনশীর গোষ্ঠি নিজ প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করলেন। তাদর মনে বিরোধীদের ভয়-ভীতি প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে। তাদের পশ্চাদ অবলম্বন সত্তেও প্রস্তাবিত মাদরাসা সেই সমজিদেই আরম্ভ হয়।
মাদরাসা শুরুর ধরণ ও স্থান নির্ধারণ :
মাদরাসা শুরুর ধরণ ছিলো এরকম, নোয়াখালীর অধিবসিী মাওলানা মুসলিম নামক এক আলেম জিরি মাদরাসা থেকে লেখাপড়া শেষ করে পটিয়ার পূর্ব পার্শে গোবিন্দরখীল নামক স্থানে এক মকতবে বাচ্চাদেরকে পড়াতেন। মরহুম মনু মিয়া দফাদার সাহেব সে মকতবের জিম্মাদার ছিলেন। মাওলানা মুসলিম সাহেব মনু মিয়া দফাদারসহ তাদের বাচ্চাদেরকে নিয়ে আমাদের বৈঠকে হাজীর হন। হযরত মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব রহ. মাওলানা ইয়াকুব সাহেব রহ. কে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতঃ সে বাচ্চাদেরকে সূরায়ে ফাতেহা পড়িয়ে দিতে অনুরোধ করলেন। মালোনা ইয়াকুব সাহেব খুতবায়ে মাসনুন পাঠ করে সূরা ফাতেহা পড়িয়ে দেন। আর উপস্থিত সকলের ঐক্যমতে মাদরাসার নাম কাসেমুল উলুম রাখা হয়। মুনাজাতের মাধ্যমে বৈঠক শেষ হয়। কিন্তু জায়গার ব্যাপারে সবার অন্তরে দুঃচিন্তা থেকে যায়। রাত্রে সবাই মাওলানা হামিদুর রহমান সাহেবের ঘরে একত্রিত হলেন। রাতভর চিন্তা ভাবনা চলতে থাকে । কারো চোখে ঘুম নামলো না । মাওলানা মুসলিম সাহেব বলেন মনু মিয়া দফাদার ও একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়তো তাদের সাথে পরামর্শ করলে সমস্যার সমাধান হবে। যথারীতে তাকে ডাকা হলো এবং ব্যাপার টা শুনানো হলো। দফাদার সাহেব নিজেও জুমার পরের বৈঠকে শরিক ছিলেন। তাই এ ব্যাপারে তিনি পূর্ব থেকে অবহিত ছিলেন। তিনি বললেন, আমি নিজ মসজিদে আপনাদেরকে জায়গা দিতে পারবো। আপাতত সেখানেই মাদরাসা করা হোক। ভবিষ্যতে আল্লাহর তৌফিক অনুযায়ী চিন্তা-ভাবনা করা হবে। তবে আমার একটি দাবী থাকবে যে, মাদরাসা কখনো যেন আমার জমির পরিধি পরিসীমা থেকে (জায়গা) থেকে স্থানান্তরিত করা না হয়। তার উৎসাহ ব্যঞ্জক কথায় সকলে আনন্দাপ্লুত হলেন। শোকের রাত ঈদের প্রভাতে পরিণত হয়ে যায়। সবাই তার দাবি মেনে নিলেন। ভোরে সভা সমাপ্ত হয়। মৌলানা আহমদ সাহেব, মৌলানা ঈসা সাহেব, মৌলানা মুসলিম সাহেব ও মৌলানা আমজাদ সাহেব (জিরভী) তখনকার জন্যে মাদরাসার দায়িত্বশীল নিযুক্ত হন। কিছু দিন মাদরাসা সে মসজিদেই চললো। এরপর বর্তমানে উত্তর পার্শে যে সব দোকান রয়েছে তম্মধ্যে কিছু দোকান খালি ছিলো। সেখানেই মাদরাসা স্থানান্তরিত করা হয়। কিছুদিন পর দফাদার সাহেবের শশুরালয় থেকে আড়াই গন্ডা জমি ক্রয় করা হলো তার মূল্য বাকি ছিলো। আমি পটিয়াতে হাজির হলে সেই পাওনা আদায় করে দেই। অতঃপর সেই জমিতে একটি বাশের ঘর নির্মাণ করা হলে মাদরাসা সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। এ ঘরের খরচাদিও কর্জ করে আঞ্জাম দেওয়া হয়। আমি যখন পটিয়াতে এসে যায় তখন ঐ কর্জও আদায় করে দিই। এ পর্যন্ত কাজ আমার অনুপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়। তবে কোনো সময় আসা যাওয়া করতাম এবং ছোট বড় পরামর্শ সভায়ও শরিক থাকতাম।
জামিয়া পটিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা:
যেহেতু শায়খুল মাশায়েখ হযরত মাওলানা জমীরুদ্দিন সাহেব রহ. এর ইঙ্গিতে এ পবিত্র দ্বীনি খেদমতের সুচনা হয়। তাই তিনিই এ মাদরাসার পৃষ্ঠপোষক মুরব্বি ও উপদেষ্ঠা ছিলেন। তখন ১৩৫৮ হিজরি সনের জুমাদাল উলায় হযরত ইহকাল ত্যাগ করলেন তখন শুধু মাদরাসা নয়; বরং সমস্ত বন্ধু-বান্ধব গুণগ্রাহি ছাত্র শিক্ষক ও তাঁর সাথে সম্পৃক্ত সকল ভক্ত অনুরক্তের উপর থেকে তার ছায়া সরে গেলো। সেই বৎসরই শাওয়াল মাসে আমি জিরি থেকে পটিয়া প্রত্যবর্তনের সংকল্প করলাম। সুতরাং সেই বৎসরের মাহে রমযানুল মোবারকে হযরত শায়খুল ইসলাম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর সাথে এতেকাফ করার ইচ্ছায় সিলেট সফর করলাম। সাথে সাথে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পটিয়া মাদরাসাকে ধন্য করার ইচ্ছা হলো এবং এ বিষয়ে একটি দরখাস্ত লিখে হযরতের খেদমতে পেশও করলাম।
হযরত মাদানী সংক্ষিপ্ত আলাপের পর দরখাস্ত মঞ্জুর করলেন। উক্ত পৃষ্ঠপোষকতা শুধু এতটুকুই ছিলো যে, মাদরাসা ওমাদরাসার সেবকগণ যেন হযরতের মহান ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বরকত অর্জন করতে থাকেন। তবে তিনি সময় ও সুযোগের অভাবে মাদরাসার কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করতে অর্থাৎ উপস্থিত হয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন।
আল্লাহর শোকর এখনো পর্যন্ত হযরতের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদরাসার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তার বরকতের কি কারিশমা তা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করেছে। তিনি সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করতে না পারলেও যে মহান ব্যক্তিবর্গ মাদরাসার কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন, তারা হলেন-
১. হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ রহ. প্রতিষ্ঠাতা দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী।
২. হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ সাহেব রহ. মুহাদ্দিস দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী।
৩. হযরত মাওলানা আহমদ হাসান রহ. মুহতামিম জিরি মাদরাসা।
তাঁরা জামিয়ার অতি শুভার্থি ও দানশীল ও বিশেষ উপদেষ্ঠা ছিলেন।
শোকের পয়গাবাহী মৃত্যু:
কবি বলেন,
کلیوں کی زباں بندہے پھولوں کی قباچاک۔ بلبل ہمہ فریادہے گلشن ہمہ خاشاک
কবির মুখ বাধা, ফুলের পাপড়ি কাটা, বুলবুলি সব বিলাপ করে,বাগানে আবর্জনা।
সময় আপন গতিতে চলছিল। যথারিতি দিন ও রাতের বিবর্তন হচ্ছিল। সময় বরফের ন্যায় গলে হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। পটিয়ার দিন-রাত যথানিয়মে কাটছিল। ঘরের বাইরে-ভেতরে কোন ধরনের অস্থিরতা বিপদের ভয় ছিল না। কেননা হযরত এমন কোন রোগে আক্রান্ত ছিল না যে, এটা তার মৃত্যুশয্যা বা মৃত্যু রোগ হিসাবে গন্য করা যায়। স্বাভাবিকভাবে বয়সও অনেক বেশি হয়নি। মাত্র ৫৭ বছর বয়স ছিল। মৃত্যুর সময়(যেখানে সামান্য আগ-পিছ হবার সম্ভবনা নেইএবং যার সময় হায়াত-মওতের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো জানা নেই) এত নিকটবর্তি তা আমাদের কারো ধারনা হয়নি।
জনাব আলহাজ¦ মাওলানা গোলামুর রহমান সাহেব কুতুবী(বিশিষ্ট খাদেম)মাদরাসার শিক্ষা জিবন শেষ করে কয়েক বৎসর হযরতের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু তিনি হযরতের মনের ভাব ধরতে খুবই পারদর্শি হিসেবে জানতে চাইলে এমন এক জবাব দিলেন যে,আমার শরিরের সমস্ত লোম শিউরে উটল এবং চোক অশ্রæসিক্ত হয়ে গেল। জবাব টি ছিল এই যে, “ভাই!আমি তো রাত-দিন কিভাবে হযরতকে তৃপ্ত ও তুষ্ট করব? হযরতের কি প্রয়োজন হচ্ছে? তা-নিয়ে মেতে ছিলাম। হযরত কি বলেছেন ও কি করেছেন তা আমার খবরও ছিল না।” এক সময় তিনি(বর্তমান)নিজ বাড়ি খরনায় চলে গিয়ে ছিলেন। মৃত্যুর পুর্বে খুব সম্ভব রমজানের শুরুতে হযরত আবারও তাঁকে ডেকে সাথে রেখে ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে লেনদেন এবং হিসাব-নিকাশের অঢিট করাতেন। জিনিস-পত্র কেনা-কাটা করাতেন এবং হযরতের প্রয়োনীয় কাজ করাতেন। রমজানের চৌদ্দ তারিখ এল। সে দিন বৃহস্পতিবার ছিল। তিনি বলেন,সেদিন সন্ধা থেকে হযরতের কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। মাগরিবের পর খাবার দস্তরখানানায় বড় জামাতা জনাব মাওলানা সাজেদুল্লাহ সাহেব এবং মেজ জামাতা হযরত মাওলানা আতিক সাহেব ছিল।তাদের সাথে কথাবার্তায় পিতৃসূলভ ¯েনহ ওদয়া তো ছিল কিন্তু কতাবার্তার ধরণ ছিল ভিন্ন। ফলে উপস্থিত সকলে অবাক হল- আজকের কথাবার্তা অন্য রকম কেন?এশার নামাজ জামাতে আদায় করে যে হাফেজ খতমে কোরআন শুনাচ্ছিল তার পিছনে তারাবির নামাজও আদায় করলেন। তারাবির নামাজের পর রুমে কিছু নাস্তা খেলেন এবং ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। আনুমানিক রাত ১২টায় রুমে আমাকে (মাওলানা গোলামুর রহমান সাহেবকে) ঘুম থেকে জাগিয়ে বললেন,দেখ, আমার ঘুম আসছেনা। আমার মাহবুব (বড় ছেলে) শরীর মালিশ করে দিয়েছে তবুও ঘুম আসেছেনা। অস্থিরতা বেড়ে চলছিল। এরকম চাঞ্চল্যের মধ্যে রাত অতিবাহিত করলেন। শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে বাসায় এলেন। হযরত মাওলানা ইবরাহীম সাহেব হয়ত প্রথম থেকেই দরখাস্ত করে রেখেছিলেন। তাকে ডেকে বাইয়্যাত করালেন। নোয়াখালী থেকে কয়েকজন মাদ্রাসার শিক্ষক এসেছিলেন। তাদেরকে মাদরাসা সম্পর্কে কিছু নছিহত করে শু’তে চাইলেন। কিন্তু সে অশান্তি প্রবল হচিছল। বাহ্যত যার কোন কারণ ছিল না। তাই ঘুম আসেনি। উটে কুরআন তিলাওয়াতে লিপ্ত হয়ে গেলেন। তিলাওয়াত সমাপ্ত করে ঘরের সামনে একটি পর্দার বন্দোবস্ত করালেন। একজন আলেমকে বললেন, তুমি দারুল হাদিসে উটে দেখ যে, সেখান থেকে আমার শরীর দেখা কিনা। তিনি এসে মনমত রিপোর্ট দিলেন। তখন হযরতের শান্তি এল। পূর্বোল্লিখিত মাওলানা গোলামুর রহমান বলেন,এই দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা সত্বেও অজিফা ও যিক্র এবং আমলের মধ্যে কোন রকম ব্যতিক্রম হয়নি। অভ্যাস অনুযায়ী সকাল বেলা তিলাওয়াতে অতিবাহিত করলেন। বেলা ১১টা পর্যন্ত এতে মগ্ন ছিলেন। এর পর জুমার নামাজের জন্য তৈরী শুরু করলেন। নাপিতকে ডেকে মাথার চুল কাটালেন। আমার দ্বারা হাত-পায়ের নখ কাটালেন। আনুমানিক সময় সাড়ে বারটা হয়েছিল। ক্ষৌরকার্য এবং গোসল সেরে শরীর মুছছিলেন। হঠাৎ হযরত বেহুশ হয়ে ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন। চতুর্দিক হতে কিছু ছাত্ররা দৌড়ে এল। আমরা ধরে হযরতকে চৌকিতে শুইয়ে দিলাম। ডাক্তার ডেকে আনলাম। ডাঃ কামাল সাহেব এসে স্টেথোস্কোপ লাগালেন। তখন ডাঃ সাহেব “হুজুর তো আর নেই” বলে চিৎকার করলেন এবং ঢলে পড়লেন। এরপর মরহুম ডাঃ হাবিবুল ওয়াহেদ সাহেব আসলেন। তিনিও শিরা দেখে উটলেন। তখন সবাই জানতে পারল যে, হযরতের প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে এবং প্রাণ তার ¯্রষ্টার কাছে পিরে গেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিয়ূন। কবি বলেন-
ایں جان عاریت کہ بحافظسپرددوست۔ روزے رخش بہ بینم وتسلیم وے کنم
অর্থ : এ প্রাণ তো (হাফেজ সিরাজীকে) বন্ধুই ধার স্বরুপ অর্পন করেছিলেন একদিন তার চেহারা দেখে তাঁর কাছে সোপর্দকরবো।
পৃথিবীতে তো সবাই চলে যাওয়ার জন্যই আসে। মৃত্যুর সময় এলে গড়িমসি না করে আত্মসমর্পনের মাথা ঝুকানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ সমস্ত আল্লাহ ওয়ালা লোকদের অবস্থা তো অন্যরকম। তাদের জন্য এদিন উৎসবের দিন। তারা এইশেষ মূহুর্তের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকেন-
دن گنے جاتے تھے اس دن کے لئے
“গণনা করত দিন সে দিনের অপেক্ষায়।” পূর্ব হতে তিনি চুপে চুপে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রমযান মাসের শুরু থেকে যিক্র তেলাওয়াত এবং আল্লাহর স্বরণে নিমজ্জিত ছিলেন। আজ ১৫ই রমযানুল মোবারক রোজ শুক্রবার ক্ষৌরকার্য এবং গোসল ইত্যাদি শেষ করে পরিপুর্ণভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে জুমার জন্য দেহ উপস্থিত করার কথা ছিল।
يأايتهاالنفس المطمئنة ارجعى الى ربك راضية مرضية فادخلى فى عبادى وادخلى جنتى
হঠাৎ হে প্রসান্ত মন, তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষ ভাজন হয়ে, অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তরভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।” –এ আওয়াজ এল এবং দেহের পরিবর্তে পবিত্র আত্মা ‘লাব্বায়েক’বলে উপস্থিত হল। ইন্না লিল্লা…………।
চতুর্দিকে এখবর বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গুণগ্রাহী ভক্তদের নিকট মাদরাসার পক্ষ থেকে টেলিফোন যোগেদূঃখজনক সংবাদ জানিয়ে দেয়া হল। যেহেতু আকস্মিকভাবে এই ঘটনাটা ঘটেছিল। তাই এই সংবাদ ভক্তদের অন্তরে তীর ও বর্শার মত বিঁধেছিল। সবার মনে নিজের ব্যর্থতার অনুভুতি উকি দিয়েছিলেন যে, আমরা আল্লাহ প্রদত্ত এ বড় নিয়ামতের মুল্যায়ন করিনি। আজ হারিয়ে বুঝছি। জমিরিয়া মাদরাসার সর্বত্র শোকাচ্ছন্ন ছিল। আশ্চর্য এক মলিনতা ছেয়েছিল দিকে দিকে। যে যেখানে ছিল সেখান থেকে পাগলের মত পটিয়ার পথে ছুটেছিল। লিখক এক সপ্তাহ পূর্বে হযরতের সাথে ঘরে খাবার খেয়ে গিয়েছিলেন। এই শুক্রবারে কোন প্রয়োজনে চট্রগ্রাম শহরে এসেছিলাম। আমি আমার এক বন্ধুকে চট্রগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লায় খোঁজ করছিলাম। যারা জানত তারা বলল সে পটিয়া গিয়াছে। হযরত মুফ্তি সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। আমি মনে মনে বললাম,হে আল্লাহ একি শুনছি,এটা কি সঠিক না বানোয়াট গুজব?কিন্তু এই দোদুল্যমানতাও আশ্চর্য এক দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। পটিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। যখন জানালীহাট ষ্টেশনে পৌছলাম, কি দেখলাম! কোদালা সরফভাটাসহ রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন এলাকার লোকজন ট্রেনের অপেক্ষা করছে। সেখানে আমার অনেক পরিচিত লোকও ছিল। হযরতের চাচাতো ভাই মাওলানা নূর মোহাম্মদ সাহেবও ছিলেন তাদের সাথে। তিনি একই এলাকার এক মাদরাসায় পড়াতেন। এখন দিড় বিশ^াস হয়ে গেল যে,এই ট্রাজেডী বাস্তবেই ঘটেছে। অন্তরের গতি যেন থেমে গেল। কবি বলেন,
أيتهاالنفس أجملى جزعا- إن الذي تحذرين قدوقعا
হে মন, তুমি শান্ত হও, যে বিপদের আশঙ্কা ছিল, তা ঘটে গেছে।
কিন্তু ধৈর্যের শক্তি কোথায়। ধৈর্যের পান পাত্র আজ টাল মাটাল হয়ে পড়েছে। কারণ,বর্তমান বিশ্বে আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব, আমার দয়ালু মুরব্বী,আমার আধ্যাত্মিক গুরু ও পথ প্রধর্শক, আমার আসা-ভরসার ক্ষেন্দ্রস্থল আজ দুনিয়া ছেড়ে আখেরাতের পথে রয়েছেন। আমি এশার সময় পটিয়া পৌঁছি। হযরতকে দেখার জন্য রুমে ডুকলাম। ভীড় না হবার জন্য সেখানে এক দিকে ঢুকে অন্যদিকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নূরানী চেহারায় দৃষ্টি দিয়ে খাট ধরে বসে গেলাম। দেখলাম হযরতের চেহারায় মৃত্যুর কোন চিহ্ন নেই। এমন দেখাচ্ছে যেন কাজকর্ম থেকে অবসর হয়ে কিছুক্ষণ বিশ^াম নিচ্ছেন। চেহারা নূরে ভাস্বর ঠোট যুগলে মৃদু হাসি যেন ঝুলে আছে। বড় ভাই হাফেজ মাহবুবুর রহমান সাহেব ঘরের ভিতর থেকে কেঁদে কেঁদে এসে বললেন-দেখ! আব্বাজান, মুসকি হাসছেন। হযরতের বিদায়ী সাক্ষাতে আগতদের উপর আল্লাহর পক্ষ হতে প্রশান্তি ধৈর্যের এক অনুপম ছায়া বিম্বিত হত। দূর থেকে চিৎকার করে কেঁদে আসত আর রুমের কাছে আসতে না আসতে প্রশান্তির মৃদু মলয় যেন শরীর ছুয়ে যেত। সারা রাত আজিজি দরবারের ভক্তরা দলে দলে আসছিল। মধ্য রাতে হযরত হাজ¦ী সাহেব ও মুফ্তি ইব্রাহিম সাহেব এবং বোয়ালভী সাহেব প্রমুখগণ হযরতের গোসল এবং কাপনের ব্যবস্থা করলেন।
মৃত্যুর পর :
হযরতের মৃতদেহ গোসল শেষে কাপন পরিয়ে খাটের উপর রাখা হল। নূরানী চেহারাখানী উম্মুক্ত রাখা হয়েছিল যেন দর্শকগন তা দেখে ধন্য হয়। সকাল পর্যন্ত মাদরাসা প্রাঙ্গণ হাশরের রুপ নিল। আজিজি জ্ঞান আহরণ কারীগন একে অন্যেকে জড়িয়ে সমবেদনা বিনিময় করছিল এবং অশ্রæ ঝরাচ্ছিল। কোন কোন আত্বীয়-স্বজন ও প্রীয়জন কান্নায় বেঙ্গে পড়েছিল আবার কেউ কেউ হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিল। সে করুণ অবস্থার বর্ণনা দিতে গেলে মূখ ও কলম রুদ্ধ হয়ে আসে। জিরি মাদরাসার তদানিন্তন মহাপরিচালক মাওলানা আহমদ হাছান সাহেব রহ. যিনি হযরতের পিতৃসম ছিলেন, তিনি এসে মসজিদে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। াতান জানাযার নামাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন যে, আমি আসতে আসতে চিন্তা করছিলাম যে,আমার মুফ্তি সাহেবের জানাযার নামাজ পড়ানোর জন্য তো মানুষ আমাকে বলবে কিন্তু যত বড় লোক তত বড় ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। শাহী জামে মসজিদের খতিব হযরত সৈয়দ আব্দুল করিম মদনী প্রথমত তিনি রাসূলের বংশধর, দ্বিতীয়ত তার সাথে মুফ্তি সাহেবের গবীর সম্পর্ক ছিল, আমি তাকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠিয়েছি। শেষবারেরমত দেখার জন্য লোকজন এমন ভাবে ভীড় করতে আরম্ভ করল যে খাটের উপর উপছে পড়ার ভয় হয়েছিল। রুমের সামনে থেকে জানাযা পশি^ম লাইনে কাতারের সামনে আনতে বিপূল সময় লেগেছিল। যারা নিয়ে আসছিল তাদের খুব কষ্ট হয়েছে। কেউ খাট ধরতে চাইত, কেউ দেখতে চাইত আর কেউ আতর ছিটাতে চাইত। কোন রকমে ভীড় ঠেলে জানাযা সামনে আনা হল এবং হযরত সৈয়দ সাহেব নামাজ পড়ালেন। মসজিদের পেছনে উত্তর-পশি^ম কোণে কবর তৈরী করা হয়েছিল। আনুমানিক যোহুরের পুর্বে এই এলম ওমারেপথের রবিকে মাটিতে ঘচ্ছিত রাখা হল। হযরত মাওলানা আহমদ হাছান সাহেব রহ. দাফনের পর এক বৈঠকে বলেন-অনেক বড় বড় ওলামা-মশায়েখের জানাযায় আমার উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে, কিনতু আমার “আজিজ”-এর জানাযায় মানুষের যে ভীড় দেখলাম তা আর কোথাও দেখিনি। জানাযায় উপস্থিত লোকের সংখ্যা দর্শকের ধারনা মতে পঞ্চাশ হাজারের উর্ধ্বে ছিল।
আকার-আকৃতি :
হযরতের শরীর মধ্যম আকার ছিল। কিছুটা উপরমুখী ছিল। শরীরের উজনও ছিল মাঝারি। রং ছিল লালচে গোধূম বর্ণের। চেহারা ছিল উজ্জল। ললাট ছিল প্রোজ্জল বিস্তৃতত। মাতা বড় তবে ভারসাম্যপূর্ণ ছিল। চুল মোবারক ঘন ও মসৃণ ছিল। চোখ দুটি বড় বড় ও খুব সুন্দর ছিল। দৃষ্টি সব সময় নিচের দিকে থাকত। চশমা পরতেন। কোন সময় চশমার ভিতরে চোখ তুলে তাকালে ভয় ধরে যেত। মুখ প্রসস্থ দাঁত মুক্তামালার ন্যায় ঝক ঝকে ছিল। হাসলে খুব সুন্দর দেখাত। নাক বেশি উচুও ছিল না। নাকের পর্দা ছিল উজ্জল। হাতের তালু প্রসস্ত ও নরম ছিল। আওয়াজ বড় ও পরিস্কার এবং স্বর আকর্শনীয় ছিল। চলার সময় পা উঠিয়ে হাঁটতেন। ঘাড় অধিকাংশ বাম দিকে ঝুঁকে থাকত। চুপ করে বসে থাকলে উপস্থিতদের উপর গাম্ভির্যের চাপ পড়ত। সব ধরনের পোষাক হযরতের শরীরে সুন্দর মানাত। কেউ তাকে প্রথমে দেখলে সে প্রথমে কিছুটা ভীত হত তার ধীরে ধীরে ঘনিষ্ট হয়ে উঠত। যৌবনকালে হযরতের উপর আধ্যাত্মিক সাধনা ও চেষ্টার প্রভাব এবং খোদা প্রেমের চাপ ছিল। সে পরিশ্রম ও চিন্তা-ফিকিরের দরুণ হযরতের চুল ও দাড়ির মধ্যে বার্ধক্যর চিহ্ন খুব তাড়াতাড়ি এসে গিয়েছিল। পঞ্চাশ বয়সে বৃদ্ধ শায়েখেরমত মনে হত। তবে চেহারা ছিল তারন্যদীপ্ত। শেষ বয়সে হযরতের মধ্যে প্রিয়ের শান(শানে মাহবুবিয়ত)চলে এসেছিল। আমরা জীবনে এমন উজ্জল ও সমান ছাঁচের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লোক আর দেখেনি যার সব কিছুই ছিল সুন্দর আর সব কথাই ভাল এবং এ রকম গাম্ভীর্য ও লাবন্যের সমন্বিত ব্যক্তি, বাহ্যিক সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক গুনের সমান অধিকারী অন্য কাওকেও দেখেনি।
بسیارخوباں دیدہ ام اما توچیزے دیگری
অনেক সুন্দর দেখেছি আমি, কিন্তু এর চেয়ে ভিন্ন তুমি।
হযরতের সন্তান-সন্ততি :
সন্তান-সন্তুতি: ইন্তিকালের সময় হযরত মুফতী সাহেব হুজুর তিন ছেলে চার মেয়ে ও অসংখ্য ছাত্র-শীষ্য ও ভক্ত অনুরক্ত রেখে যান। তিন ছেলে হলেন ঃ
১. মুহতারাম হফেজ মাওলান মাহবুবুর রহমান সাহেব রহ.। প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম, দোহাজারী মাদরাসা।
২. হাফেজ মুহিববুল্লাহ সাহেব রহ.। শিক্ষক, জামিয়া পটিয়া।
৩. মাওলান মুহাম্মদ ইসমাঈল সাহেব রহ. শিক্ষক, জামিয়া পটিয়া।
হযরতের জীবদ্দশায় আরো তিনজন ছেলের ইন্তেকাল হয়। তার হলেন,
(১) মাহফুজুর রহমান, (২) মাহমুদুর রহমান,(৩) সুলাইমান (তার ইন্তিকাল কিন্তু হযরতের ইন্তিকালের একমাস পারে হয়)।
আর চার মেয়ে হলেন:
১. মুহতারামা ফাতেমা-তার বিবাহ জনাব মাওলানা সাজেদুল্লাহ হওলভী রহ.‘র সাথে হয়।
২. রুকাইয়া, তার বিবাহ শায়খুল মাশেয়েখের ছেলে মরহুম মাওলানা আতীক রহ.-এর সাথে হয়।
৩. আছিয়া-মাওলানা মুতাইয়্যিব সাহেব রহ.’র সাথে তার বিয়ে হয়।
৪. সালমা, রাজঘাটা হুসাইনিয়া মাদরাসার সাবেক মুহতামিম মাওলান নূরুল আমীনের সাথে তার বিয়ে হয়। হযরতের স্ত্রী মুহতারামা (আম্মাজান) এখনও জীবিত আছেন। শয্যাশায়ী হয়ে বার্ধ্যকের জীবন কাটাচ্ছেন। (তিনি বিগত ইনতেকাল করেন। হযরতের ইনতেকালের চল্লিশ বছর পর) এছাড়া হযরত লক্ষাধিক ছাত্র-শিষ্য-মুরীদ ও অগণিত ভক্ত-অনুরক্ত রেখে যান। যারা পাক-ভারত বাংলাদেশ ও বার্মার বিভিন্ন এলাকাসহ অন্যান্য দেশে ছড়েয়ে আছেন এবং শিক্ষা-দীক্ষা ও দ্বীনের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন।
হযরতের ইজাযতপ্রাপ্তদের নাম :
তাদের মধ্য থেকে প্রখ্যাত ছাত্রদের নাম এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ওলামায়ে কেরামের মধ্যে সম্ভ্রান্ত দল আছেন। যারা তাঁর হাতে বাই‘য়াত হয়ে কিংবা তাঁর দিকে রুজু করে ইজাযত প্রাপ্ত হন। তাঁদের তালিাকা নি¤েœ প্রদক্ত হল:
১। মাওলানা আলী আহমদ সাহেব বোয়ালভী, শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া।
২। মাওলানা হোসাইন আহমদ সাহেব কেসুয়াভী, জামিয়া পটিয়া। সদর, পোকখালী মাদরাসা।
২। মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক হ্নীলভী,শিক্ষক, জামিয়া পটিয়া। সদর পোকখালী মাদরাসা।
৪। হাফেজ রহমতুল্লাহ সাহেব গড়দোয়ারভী, শিক্ষক, জমিরিয়া কাসেমুল উলূম মাদরাসা,(ওফাত জিলহজ¦ ১৩৭০হিং)
৫। মাওলানা মুহাম্মদ হরুন সাহেব, মুহতামিম, মাদরাসা আজিজীয়া বাবুনগর ফটিকছড়ি, চট্টগাম।(ওফাত জিলহজ¦ ১৪০৬হিং) চার খান্দানের ইজাযতপ্রাপ্ত
৬। মাওলানা মেহেরুজ্জামান সাহেব কোদালভী, মুহতামিম, মাদরাসা মুয়াবিনুল ইসলাম, সরফভাটা, চট্টগাম ।ওফাত:
৭। মাওলানা আহমদ ছফা সাহেব, সাং সাবেক রাংগুনিযয়া, (শাহ সাহেব) চট্টগাম (ওফাত শাওয়াল ১৪২৫হিং)
৮। মাওলানা আলী আহমদ সাহেব, মুহতামিম, মাদরাসা হোসাইনিয়া বোয়ালিয়া, আনোয়ারা। (ওফাত ১৪২৫হিং)
৯। মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সাহেব, কুমিল্লা,
১০। মাওলানা মফজল আহমমদ সাহেব, মুহতামিম,মাদরাসা রশীদিয়া বেশারত নগর চট্টগ্রাম (ওফাত হিং)
১১। মাওলানা সালোম জান সাহেব, মুজাহিদ কাশ্মীর, সীমান্ত প্রদেশ, পাকিস্তান।
১২।মাওলানা সৈয়দ আহমদ সাহেব রামুভী, (সাবেক শিক্ষক, চাকমারকুল দারুল উলুম মাদারাসা, রামু, ককসবাজার । ওফাত ২৩ জামাদাল উলা ১৩৯১ হিং।
১৩। মাওলানা মুহিউদ্দন সাহেব হ্নীলভী ককসবাজার ।
১৪। মাওলানা আব্দুর রশীদ সাহেব হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
১৫। মাওলানা আমীর হোসাইন সাহেব, মুহাদ্দিস, মাদরাসা জমিরিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।
১৬। মাওলানা সুলতান আহমদ সাহেব (নানুপুরী), মুহতামিমম, মাদরাস ওবায়দিয়া, নানুপুর।
১৭। মাওলানন নুরুল ইসলাম সাহেব থানা মুহরভ, শিক্ষক, মাদরাসা জমিরিয়া চট্টগ্রাম।
১৮। মাওলানা আবুল হাসান যশোরী, মুহতামিম, এজাজিয়া দারুল উলুম, যশোর।
১৯। মাওলানা হাফেজ আহমদুর রহমান,মুহতামিম, কোদালা মাদরাসা )
২০। মাওলানা আহমদ রেযা সাহেব, সাং- মধুগ্রাম, নোয়াখালী ।
২১। ডা. মুহাম্মদ ইসমাইল সাহেব হওলভী, চিকিৎসক, দেয়ান বাজার, চট্টগ্রাম ।
২২। মাওলানা হাফেজ সুলতান আহমদ, শিক্ষক, হোসাইনিয়া রাজঘাটা, ।(ওফাত ১৪০১হিং)
২৩। মাওলানা বদিউর রহমাদ সাহেব রাউজানী, শিক্ষক, মাদরাসা আজীজিয়া মাতারবাড়ী, মহেশখালী, ককসবাজার। (ওফাত২৮রবিউল আউয়াল ১৪০৬হিং)
২৪। মাওলানা আব্দুল মজীদ,শিক্ষক,মাদরাসা জামালপুর, মিরসরাই।
২৫। মাওলানা বজলুস সুবহান, মুহতামিম, মাদরাসা জামালপুর, মিরসরাই।
২৬। মাওলানা মুহম্মদ সোলাইমান সাহেব সাং- মধুগ্রাম, নোয়াখালী।
২৭। মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব বুরুমচারবী, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম।
২৮। মাওলানা (এখানে যার নাম ছিল, তার ইজাযত হযরত বাদ দিয়া দেন)।