জামিয়ার সোনালী অতীতকে সংরক্ষণ, বর্তমানকে সমৃদ্ধ ও ভবিষ্যৎকে বর্ণিল করুন

জামিয়ার সোনালী অতীতকে সংরক্ষণ, বর্তমানকে সমৃদ্ধ ও ভবিষ্যৎকে বর্ণিল করুন

ড. মাহমুদুল হাসান আল-আযহারী

[ড. মাহমুদুল হাসান আল-আযহারী (হাফি.)। একজন বরেণ্য আলেমে দ্বীন ও আর্ন্তজাতিক দাঈ। তিনি ইংল্যান্ডের দ্যা এসেক্স মসজিদ কমপ্লেক্স-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক সফল শিক্ষক। বিগত ১৬ই অক্টোবর ২০২৩ ইংরেজী (সোমবার) বাদ যোহর জামিয়ার শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। সকলের উপকার্থে বক্তব্যের চম্বুকাংশ প্রদত্ত হলো]-

আমার সেই সোনালী অতীত ফিরে পেতে চাই!

আজ এই সুন্দর, সবুজ এবং মনোরম বাগানে এসে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এ ক্ষুদ্র জীবনে তোমার সবচেয়ে প্রিয় দিনগুলো কোনটি? আমি আজ এই মসজিদে দাঁড়িয়ে, উম্মাহর আগামী প্রজন্মকে সামনে রেখে, নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ওই সময়টুকুই আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়,যখন আমি পটিয়া মাদরাসায় ছাত্র অবস্থায় এসেছি এবং শিক্ষক অবস্থায় কাটিয়েছি কিছুদিন। সে দিনগুলোকে আমি প্রবলভাবে মিস করি। আজ এখানে কেউ যদি আমাকে বলে, আমি আপনার সেই তারুণ্যদীপ্ত যৌবনের ওই প্রিয় সময়গুলোকে ফিরিয়ে দেব, আপনাকে নিয়ে যাব পটিয়ার ওই হারানো সময়ে, বিনিময়ে আপনি আমাকে ওয়ান মিলিয়ন পাউন্ড দেবেন। যদি এটি সত্যি সত্যিই সম্ভব হয়, এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে আমি পরিপূর্ণই প্রস্তুত। আমি তো আবারও এই জামিয়ার ছাত্র হতে চাই, ফিরে যেতে চাই ওই সোনালী দিনগুলোতে, জামিয়ার ছাত্রের তালিকায় নিজেকে তালিকাভুক্ত করে আবারও নতুন করে শুরু করতে চাই। কেউ কি আছে এখানে, আমার সেই চুক্তিতে রাজি হবে? হাত বাড়িয়ে বলবে, আমি পারবো? হ্যাঁ, আমি জানি, অনেকেই রাজি আছে। কিন্তু আদৌ তা সম্ভব নয়। সম্ভব হলে ওয়ান মিলিয়ন পাউন্ড তথা কয়েক কোটি টাকা আমার সে হারানো দিনগুলোর তুলনায় খুবই গৌণ এবং তুচ্ছ মনে হবে, তবুও আমি ফিরে পেতে চাই সেই সোনালী দিনগুলো, পটিয়ার এই প্রাঙ্গণে আমার হারানো সময়গুলো।

যে কারণে জামিয়া আসার সৌভাগ্য অর্জিত হয়:

আমি বড় হয়েছি চট্টগ্রাম শহরে। অতঃপর মেখল মাদরাসা ও জামিয়া আহলিয়া মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতেও আমার পড়ালেখার অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়। কিন্তু আমার দাদার খুব আশা ছিলো, যেন আমার সমাপ্তিটা পটিয়াতেই হয়। কারণ, আমার দাদা হযরত মুফতী আযীযুল হক রহ.-এর মুরীদ ছিলেন। এদিকে আমার বাবাও হযরত মুফতী সাহেব হুজুর রহ.-এর একজন খলীফার একান্ত মুরীদ ছিলেন। এসব কারণে আল্লাহ পাক হয়তো আমাকে পটিয়ার জন্য কবুল করে নিয়েছিলেন।

যে বটবৃক্ষের ছায়ায় ধন্য হলাম:

পটিয়ায় এসে আমি যে বড় একটি বৃক্ষ পেয়েছিলাম, যার ছায়ায় আমি অতিবাহিত করতে পেরেছিলাম কিছু সময়, সে প্রাপ্তি আমার মনোবলকে এখনও সজীব করে রাখে। যে বছর এখানে এসেছি, সে বছরই হযরত আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী সাহেব রহ. ইহতিমামের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় হুজুরের সাথে যেন পিতা এবং পুত্রের একটি গভীরতম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মনে হতো তিনি তাঁর প্রতিটি ডানা আমার জন্য বিছিয়ে দিয়েছেন। সযত্নে আগলে রেখেছেন বুকে, একান্ত নিবিড় পরিচর্যায়। হুজুর আমাকে বারবার বলতেন, ‘আমি যাকে বুক দিই, তাকে পিঠ দিই না’। তিনি যখন ফারেগ হবার পর আমাকে এ জামিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, হযরতকে আমি বলেছিলাম, আমি তো আরও পড়াশোনা করতে চাই, উচ্চতর শিক্ষার্জন করতে চাই। আমার ভেতরে জেদ ছিলো আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করবো, ইলমী রিহলাহয় আত্মনিয়োগ করবো, এখানে দায়িত্ব গ্রহণ করলে তো আমার সে আশা-আকাঙ্ক্ষা সব ভেস্তে যাবে। সবকিছু শুনে হুজুর আমাকে বললেন, ‘শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে আমল-আখলাক ঠিক থাকবেনা। এখানে আসাতিযায়ে কেরামের সোহবতে থাকো আর ওখানেও পড়াটা চালু রাখো’। আমি বিস্মিত হয়ে বলেছিলাম, ‘আমাকে এভাবে নিয়োগ দিয়ে আপনি তো সমালোচিত হবেন, লোকে আড়ালে আপনাকে অনেক কিছু বলবে’, তখন হযরত আমাকে বলেছিলেন ‘আমি যাকে বুক দিই, তাকে কখনো পিঠ দিই না’।

সত্যিই আমি একটি বটবৃক্ষ পেয়েছিলাম তখন, পেয়েছিলাম অতুলনীয় যোগ্যতার অধিকারী একজন মহান উস্তাযকে, যিনি কথা বলতেন চমৎকার উচ্চারণে, উর্দুপাণ্ডিত্য ছিলো যার অসাধারণ। তিনি যখন আরবী বলতেন, এই মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করতেন, মনে হতো কোনো আরব শায়েখ এসেছেন এইমাত্র। আমি বক্তৃতার সুচনায় তোমাদের সামনে যে খুতবা পাঠ করলাম, তাঁকে দেখতাম এরচেয়েও প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ আরবীতে খুতবা দিতে পারতেন। লন্ডনে যখন গিয়েছেন, চমৎকার ইংরেজিতে বক্তব্য দিয়েছেন। এত এত ভাষায় তিনি কথা বলতে পারতেন, সত্যিই বিস্ময়কর ছিলো। জনমানুষের সাথে যখন কমিউনিকেশনে যেতেন, তাঁকে দেখতাম এত সুন্দর এবং স্মার্টলি কনভারসেশন চালিয়ে যেতেন, তাদেরকে আয়ত্ব করতে পারতেন, সাধারণত অন্যান্য বুযুর্গ এবং উনার জেনারেশনের অন্যান্যদের পক্ষে এমনটি সম্ভব ছিলোনা। হতে পারে অনেকের ইলম এবং আমল তাঁর তুলনায় বেশি ছিলো, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁকে এসব অতুলনীয় যোগ্যতা দান করেছিলেন, যেখানে তিনি ছিলেন অনন্য। এজন্য পটিয়ার এই আঙিনা তখন আমার কাছে এক অবিমিশ্র ঘোর এবং স্বপ্নের মত হয়ে উঠেছিলো।

জামিয়ার সমৃদ্ধ লাইব্রেরীর অপূর্ব স্মৃতি:

আমার মনে আছে, সর্বপ্রথম যখন এখানে এসেছি, এত বিশাল এবং সমৃদ্ধ এক লাইব্রেরী দেখে বিস্ময়ে ফেটে পড়েছিলাম। হাটহাজারীতে যখন ছিলাম, তখন তো এরকম লাইব্রেরী আমার ভাবনায় শুধুই কল্পনা। সেখানে পড়ার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কুতুবখানা ছিলোনা। ছাত্রদেরকে প্রয়োজনীয় কিছু কিতাব ‘আরিয়াত’ হিসেবে দেয়া হতো। কিন্তু পটিয়ার বিস্তৃত এই লাইব্রেরী আমার সামনে উন্মোচন করেছিল নতুন এক দিগন্তের। হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব হুজুর আমাকে লাইব্রেরীতে একা রেখে চলে যেতেন, কখনো এমন হতো আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি বাহির থেকে তালা লাগিয়ে চলে গেছেন। অনেকদিনই এমন হয়েছে। দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষা চলাকালীন হযরত মাওলানা আমিনুল হক (হাফিযাহুল্লাহ) বাড়ি থেকে আমার জন্য অনেক কিতাব এনে পড়তে দিয়েছিলেন। আল্লাহ উনার হায়াতে বরকত দান করুন। পটিয়া আমাকে এমন অনেক কিছু দিয়েছে। আমার সামনে খুলে দিয়েছে নতুন একটি দিগন্ত। হযরত মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাহেব হাফিযাহুল্লাহ যখন আমাদেরকে বুখারী শরীফের কিতাবুল মাগাযী পড়াতেন, আপ্লুত হতাম অনেক। হাটহাজারী ত্যাগ করে চলে এসেছি, মনের ভেতর একটু হীনমন্যতা ছিল, কিন্তু যখনই হযরতের মুখে কিতাবুল মাগাযীর সেই তাকরির শুনতাম, সকল হীনমন্যতা এবং মানসিক পীড়া, নিঃশেষ হয়ে যেত মুহূর্তেই। হযরত বুখারী সাহেবের তিরমিযীর তাকরির শুনেও অন্তর তৃপ্ত হয়ে যেত, আরও শোনার প্রত্যাশায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠতো। হ্যাঁ, সত্যিকার অর্থেই পটিয়ার এসব আলোর স্ফুরণে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি আমি,পেয়েছি তার সযত্ন উদারতা।

জামিয়ায় শিক্ষাকতা ও আন-নাদী আচ্ছাকাফী প্রতিষ্ঠা :

এরপর শিক্ষক হওয়ার পর যে সময়গুলো আমি এখানে অতিবাহিত করেছি, নিঃসন্দেহে সে সময়গুলো ছিলো আমার যৌবনের সবচেয়ে সোনালী দিন। আন-নাদী আচ্ছাকাফীর মাধ্যমে প্রাণোচ্ছ্বল কিছু যুবকদের চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধি এবং তাদেরকে আরবী-বাংলা সাহিত্যে সমানতালে দক্ষ করে তোলাসহ অনেক কিছুই তখন হযরত আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী রহ.-এর নির্দেশনায় করার সুযোগ হয়েছিলো। আরবী শেখার জন্য এখন অনলাইনে অনেক কিছুই তো পাওয়া যায়। কিন্তু তখন আরবী বক্তব্য শোনার কোনো মাধ্যমই ছিলোনা। শুনতে শুনতেই আরবির তালাফফুয (excent) শুদ্ধ হয়। তাছাড়া আমরা যেহেতু বাঙালী, আমাদের আরবীটা একটু অনারবী স্টাইলের, তাই আরবীর মৌলিক স্টাইলটা অনুসরণের অনেক প্রচেষ্টা থাকলেও কোনো উপায় আমাদের সামনে তখন ছিলোনা। এখন ইউটিউবে হারাম মাক্কী, হারাম মাদানী এবং আকসা থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেক বক্তব্য মুহূর্তেই আমরা শুনতে পারি। হযরত হারুন সাহেব হুজুর বিদেশ থেকে সফর শেষে আসার সময় নানা জিনিস পত্রের ভাঁজে বা কখনো জিনিসপত্র মুড়িয়ে পুরাতন আরবী পত্রিকা নিয়ে আসতেন। সে পত্রিকাগুলো তখন বিভোর হয়ে পড়তাম। অনেক শব্দই তখন বুঝে আসতোনা। আধুনিক আরবী এবং মিডিয়া আরবীসহ অনেক না বোঝা আরবী শব্দগুলো দাগিয়ে রাখতাম। হুজুরকে দেখাতাম, হুজুর বলে দিতেন শব্দের অর্থগুলো। যেমন ‘ইস্তিফতা’ অর্থ আমরা জানি, ‘ফতওয়া চাওয়া’, কিন্তু আধুনিক আরবীতে এর অর্থ ‘গণভোট’। এইযে একই শব্দ মর্ডার্ন আরবীতে আরেক অর্থে ব্যবহার হচ্ছে, এটা না জানলে নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য। আবার দেখো, আরবীতে ‘জিনস’ অর্থ আমরা যেমন বলি الجنس كالحيوان, কিন্তু একই শব্দ আধুনিক আরবীতে এসে অর্থ দিচ্ছে লিঙ্গ (sex) এজন্য আননাদী আচ্ছাকাফী যখন এই জামিয়া পটিয়ায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে, এর সূচনা এসবকে কেন্দ্র করে হয়েছিলো৷ আমাকে আরবী সাহিত্যের প্রাচীনতম কিতাব মাকামাতে হারিরিয়্যাহ পড়াতে দেয়া হয়েছিলো৷ মাকামাতে হারিরি তো সেই আব্বাসী যুগের সাহিত্যনির্ভর একটি আরবী কিতাব। আমরা জেনে থাকব, আরবী সাহিত্যের পাঁচ-ছয়টা যুগ আছে৷

  • العصر الجاهلي
  • العصر الإسلامي
  • العصر الأموي
  • العصر العباسي
  • العصر الأندلوسي
  • العصر الجديدي

বিভিন্ন যুগেরই বিভিন্ন স্বকীয় ভঙ্গিমা ছিল, বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গী ছিল, যেগুলো একটা থেকে আরেকটা খানিকটা ভিন্ন৷ যেমন রবীন্দ্র-সাহিত্য এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বর্তমান সময়, এ দুই সময়ের বাংলা একরকম না৷ আবার রবীন্দ্রনাথের আগে মধ্যযুগীয় সাহিত্য বা তারও আগের প্রাচীনতম যুগ, তা আরও ভিন্নরকম৷ যুগ পরম্পরায় শব্দ, গঠন প্রক্রিয়া ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়েছে৷ তো মাকামাতে হারিরি পাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের লক্ষ্য যেহেতু আব্বাসী যুগের আরবী ভাষার গতিপ্রকৃতি জানার সাথে সাথে আরবীতে দক্ষ হয়ে ওঠা, তাই আমার মাথায় এলো, একই শব্দ আধুনিক যুগে এসে কোন অর্থে ব্যবহার হচ্ছে, আর তখন কোন অর্থে ব্যবহার হয়েছে, দুটোই যদি ছাত্ররা আয়ত্ত করতে পারে, তাহলে উভয়দিকে তারা ব্যালেন্স করে সমানতালে দক্ষ হয়ে উঠবে৷ বিভিন্ন আরব দেশে গেলেও আটকে যাবেনা আর৷ তাই মাকামাত পড়ানোর সময় আমি একদিকে প্রাচীন তাহকিকের ধারা অনুসরণ করতাম, অন্যদিকে ওই শব্দটিই আধুনিক আরবীতে কীভাবে কোন অর্থে ব্যবহার হচ্ছে, তারও একটি তাহকিক ছাত্রদের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করতাম। ছাত্রদের বিশেষ একটি শ্রেণীকে রাতের বেলা আলাদাভাবে সময় দিয়ে এসব চর্চা তখন অব্যাহত ছিলো৷ এরই মধ্য দিয়ে আন নাদী আচ্ছাকাফীর সূচনা হয়েছিল এই জামিয়া পটিয়ায়৷ সাহিত্য চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা এবং ভবিষ্যতে সামনে অগ্রসর হতে বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্টসহ আন নাদী আচ্ছাকাফীর ছিলো বহুমুখী কার্যক্রম৷ আলহামদুলিল্লা গুরুত্বপূর্ণ মহলে এই কার্যক্রম স্বীকৃতও হয়েছিল তখন। এবং এর মাধ্যমে অনেক ছাত্ররা নিজেদের প্রতিভাকে বিকশিত করার একটা মোক্ষম প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিতে পেরেছিলো৷ যার ফলে এখনও বিভিন্ন ভালো ভালো মাদরাসায় আমাদের আন নাদী আচ্ছাকাফীর ছাত্ররা সময়ের চাহিদাকে উপলব্ধি করে ছাত্র গড়ার কারিগর হিসেবে যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও তাদের পদচারণা রয়েছে। অনেকে আবার আরবী এবং সাহিত্যে জোড়ালো ভূমিকাও রাখছে। আগামী দিনেও তোমাদের ব্যাপারে আমার প্রত্যাশা থাকবে, তোমরা এই তরুণরা, আমার সামনে যারা বসে আছো, ফুল হয়ে ফুটে উঠবে একদিন৷ যার ঘ্রাণে পুরো পৃথিবী মুগ্ধ হবে। সুবাসিত হবে চারোদিকে৷ ইনশাআল্লাহ।

কওমি মাদরাসায় ছাত্র এবং উস্তাযের সম্পর্ক হচ্ছে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ :

১৯৯৭ ইং-এ পটিয়ার এই প্রিয় প্রাঙ্গণ ছেড়ে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে মিসর যাচ্ছি, ছাত্রদের কিছু চোখের পানি, আমাকে বিদায় দেবার যাতনায় তাদের ক্রমাগত ঝরে পড়া অশ্রুগুলো আমার স্মৃতিতে এখনও সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। তখন তো বর্তমান সময়ের মতো হোয়াটসএপ,টেক্সট-ম্যাসেজিং, ফেসবুক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কিছুই ছিলোনা, কিন্তু প্রতিদিনই পোস্টম্যান আমাকে একগাদা চিঠি দিয়ে যেত, যেগুলো আমার ছাত্রদের কাঁচাপাকা হাতে, ভাঙা ভাঙা অক্ষরে লেখা ভালোবাসা মিশ্রিত কিছু চিঠি। সেসব চিঠিগুলো আমার জন্য অনেক মর্যাদার। চোখের সুরমা হয়ে প্রতিদিন আমার আবেগ এবং ভালোবাসাকে সজীব করে তুলতো।

আমি পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়েছি। আযহার থেকে লন্ডন ইউনিভার্সিটিসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু এখনও পটিয়ার এই আঙিনা, এই পবিত্র উদ্যান আমি ভুলতে পারিনা। আমি তো কেবল ওই দিনগুলোকেই খুঁজে পেতে চাই, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নিছক ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ থাকেনা। যেখানে আত্মার সম্পর্ক থাকে। থাকে পিতা-পুত্রের গভীর থেকে গভীরতম সম্পর্ক। যেখানে থাকে শুধুই আবেগ, ভালোবাসা, স্নেহ এবং শ্রদ্ধার অমোঘ সম্মিলন। কিন্তু এ সম্পর্ক তো আরবের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বলি অথবা পাশ্চাত্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বলি, কোথাও খুঁজে পাইনা। যে আদব, যে ভালোবাসা, যে মর্যাদা এবং যে সুদৃঢ় বন্ধন পটিয়া মাদরাসার মতো কওমি মাদরাসাগুলো ছাত্র-উস্তাযের মাঝে তৈরি করে, পৃথিবীর আর কোথাও এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমরা চাইনা বর্তমান ডিজিটাল সময়, স্মার্ট টাইম এবং সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সেই আদবটাকে কেড়ে নিয়ে যাক। আমরা চাইনা আমাদের উস্তাযদের সাথে আমাদের সে সুমহান পবিত্র সম্পর্কের এই গতিশীলতা কেউ রুদ্ধ করে দিতে পারুক। ধ্বংস করে দিতে দুঃসাহস দেখাক সুদৃঢ় এই বন্ধন। সেটাই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের কওমি মাদরাসার মূল প্রাণটাই তো আর থাকবেনা। কওমি মাদরাসা পরিণত হবে একটা লাশে; প্রাণবিহীন লাশে। কওমি মাদরাসার বৈশিষ্ট্য কি, সেটা যদি বলতে হয়, বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা নিয়ে লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি পিএইচডি থিসিস আমাদের চোখ-কান সচকিত করতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, কওমি মাদরাসায় ছাত্র এবং উস্তাযের সম্পর্ক হচ্ছে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, যেটা পৃথিবীর অন্য কোনো শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। সত্যিই তাই, যখন আমি কোনো আরব দেশে যাই, কাতার, আরব-আমিরাত কিংবা বাহরাইনে সফর করি, এদিক ওদিক থেকে বিভিন্ন ছাত্ররা দৌড়ে এসে আমাকে বলে, হুজুর আমি তো আপনার কাছে ওই কিতাবটা পড়েছি, মাকামাত পড়েছি, আপনার কাছে আমি হিদায়াহ পড়েছি। শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়তে চায় যেন প্রতিটি ছাত্র। সে জানে আমার কাছে এলে আমি তাকে কোনো টাকা দেবনা, কোনো প্রয়োজন মিটবেনা তার এখানে। তবুও সে বুকভরা আবেগ নিয়ে দৌড়ে আসে। আমি চিন্তা করি তখন, এ বন্ধন কীসের বন্ধন! রক্তের বন্ধনের চেয়েও এ বন্ধন আরও গভীর, আরও দৃঢ় এবং পবিত্র নয় কি! হ্যাঁ, এটাই কওমি মাদরাসার বৈশিষ্ট্য।

ছাত্র এবং উস্তাযের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে ‘ইত্তিবা’-এর সম্পর্ক, সোহবত-সাহচর্যের সম্পর্ক :

আমরা কওমি মাদরাসায় বসে আয়ত্ব করেছি মুসা আলাইহিস সালামের সে শ্রদ্ধাবনত ভাষা, যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে হযরত খিযির আলাইহিস সালামের কাছে প্রেরণ করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন

هل اَتَّبِعُکَ عَلٰۤی اَنۡ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمۡتَ رُشۡدا

হযরত মুসা দরখাস্ত পেশ করছেন, ‘আমি কি আপনার ইত্তিবা’ করতে পারি, এ জন্য যে আপনি আমাকে ইলম শেখাবেন’? সরাসরি তিনি বলে ফেলেননি, ‘আপনি কি আমাকে ইলম শেখাবেন’? তাফসীরে কাবিরে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযি হযরত মুসা আলাইহিস সালামের সরাসরি না বলে ইত্তিবা’ শব্দচয়নপূর্বক দরখাস্ত পেশের মর্ম উল্লেখ করে বলেছেন, ছাত্র এবং উস্তাযের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে ‘ইত্তিবা’-এর সম্পর্ক, দীর্ঘ সোহবতের সম্পর্ক, সাহচর্যের সম্পর্ক। এটাই হচ্ছে দ্বীনি ইলম।

আমরা যখন এডুকেশনের উপর পিএইচডি করলাম, তো ডিসকাশনের সময় ইংলিশদের সামনে একটি সেমিনারে বললাম, ইসলামিক এডুকেশনের মূল প্রাণ এবং থিওরি হচ্ছে ‘transfer from chest to chest, don’t from mouth to mouth’ –অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষায় learning and teaching (পঠন-পাঠন) তথা জ্ঞান একজন থেকে আরেকজনের কাছে যাওয়ার মূল method (পদ্ধতি) হচ্ছে অন্তর থেকে অন্তর। একজনের বুক থেকে আরেকজনের বুকের আদান-প্রদান।

হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম প্রথম যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে এসেছিলেন, তখন আল্লাহর রাসূলকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বুকে জড়িয়ে ধরার আগে আল্লাহর রাসূল বলেছিলেন ما انا بقارئ” ‘আমি তো পড়তে জানিনা’। কিন্তু যখন জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে, বুকে বুক মেলালেন, তখনই আল্লাহর রাসূল পড়তে শুরু করলেন

বুক থেকে বুক, সিনা থেকে সিনার এই শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন সভ্যতার। সভ্যতার এই আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ পর্যন্ত। অন্তর থেকে অন্তরে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার এ ধারা এখন পর্যন্ত আঁকড়ে রেখেছে কওমি মাদরাসা। তো এটাই আমি বলতে চাই, আমাদের এই মূল সম্পদ, ইলম চর্চার এই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে আমরা যেন হারিয়ে না ফেলি।

ক্লিকের যুগ পেরিয়ে এখন ‘ব্লিংক’-এর যুগ সমাগত :

হয়তো বলতে পারো তোমরা, ২০২৩ইং-এর এ আধুনিক সময়ে এসে এসব সেকেলে গল্প চলবেনা। আমরা স্মার্ট যুগের মানুষ। আমাদের প্রয়োজন নিত্যনতুন মেথড। শোনো, আমরা যখন পড়ালেখা করেছি, এখনকার সময়ের এই আধুনিক সব মাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, টেক্সট-ম্যাসেজিং এবং ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ, এর কোনোটাই তো ছিলোনা। ল্যান্ডফোনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বহুকষ্টে ফোন করতে হতো। কিন্তু এখন তো ‘ক্লিক’ (click)-এর যুগ। সামনে আসবে ‘ব্লিংক’ (blink) এর যুগ। ‘ক্লিক’ মানে তো টাচ করা, স্পর্শ করা। আর সামনে যে ‘ব্লিংক’এর যুগ আসবে, সেখানে সবকিছু চলবে চোখের ইশারায়, পলকে পলকে। চোখের পাতা নড়ালেই হতে থাকবে সবকিছু। চোখের পাতা পড়বে তো মোবাইলের লক খুলে যাবে, পলক নড়বে কম্পিউটারের স্ক্রিনে মুহূর্তেই ওপেন হয়ে যাবে ফাইল। হ্যাঁ, সত্যিই ‘ক্লিক’এর যুগ থেকে আমরা ব্লিংক’-এর যুগে ক্রমশ হেঁটে চলেছি।

নিউইয়র্কের একটি পত্রিকায় আগামী একশো বছর পর পৃথিবীর চেহারা কী হবে, কোথায় থাকবে পৃথিবীর অবস্থান, এ বিষয়ে প্রায় দুইশত বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছিলো। সেখানে বলা হয়েছে, আগামী একশো বছর পর কল্পনা এবং বাস্তবতা মানুষের কাছাকাছি চলে আসবে। তুমি এখন কল্পনা করতেই পারো, ঠিক এ মুহূর্তে এখানে বসে তুমি অক্সফোর্ডে চলে গিয়েছো, এডমিশন নিয়েছো এবং অক্সফোর্ডের সুপ্রসন্ন একটি হলরুমে বসে একমনে লেকচার শুনছো। হ্যাঁ, তোমার এখনের এই ভাবনা কেবল আকাশকুসুম কল্পনা হিসেবে পড়ে থাকলেও আগামী একশো বছর পর সেটা কল্পনার পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকবেনা। কল্পনা করা মাত্রই বাস্তবতা তোমার সামনে এসে হাজির হয়ে যাবে। ধরো, তুমি ভাবছো, ড্রইং রুম থেকে এই ফার্নিচারটা বেডরুমে নিয়ে গেলে ভাল হতো। ভাবা মাত্রই সেটা এ রুম থেকে ম্যুভ হয়ে অন্য রুমে চলে যাবে। হ্যাঁ, এরকম প্রযুক্তি আসবে আর মাত্র এক শতাব্দী অতিবাহিত হলেই। তোমার কল্পনা, চিন্তা এবং ভাবনাকে মূহূর্তেই বাস্তবে নিয়ে আসবে প্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো উৎকর্ষ। যেরকম আমরা জান্নাতের নেয়ামত সম্পর্কে শুনেছি যে, কেউ দেখলো, এদিক দিয়ে একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে, তাঁর খুব করে মনে চাইলো, আহ, পাখিটা যদি খেতে পারতাম! সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা ভুনো হয়ে তার সামনে চলে আসবে। একশো বছর অতিক্রান্ত হলে দুনিয়াতেও এরকমটি হতে পারে। জান্নাতের বিভিন্ন নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল যে কাল্পনিক কিছু বলেননি, এটা যে সত্য, এর খানিকটা আল্লাহ দুনিয়াতেই আমাদেরকে দেখাতে পারেন। নাস্তিকরা বলছে, এসব তো অলীক কল্পকাহিনী, কিন্তু বিজ্ঞানীদের ভাষ্যনুযায়ী বলা যাচ্ছে, প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতায় আগামী একশো বছর পরও পৃথিবীতে এমন হতে পারে।

তাই তোমাকে বলছি হে তরুণ, প্রানোচ্ছ্বল হে নবীন, হে তালিবুল ইলম, তোমার সামনে উন্মুক্ত এখন সম্ভাবনার বিস্তৃত দুয়ার, সুবর্ণ সব সুযোগ তোমাকে ডাকছে। তোমার কাছে এখন যে অফুরন্ত সময় রয়েছে, সেটা আমার হাতে নেই। তোমার হাতে এখন যৌবনের যে তারুণ্য আছে, তোমার কাছে যে উদ্যম, যে শক্তি আছে, সেটা অত্যন্ত মূল্যবান একটি সম্পদ হয়ে তোমার কাছে এসেছে। এ-কে হেলা করোনা। মর্যাদার সবটা বিছিয়ে দিয়ে এ সুযোগকে আঁকড়ে ধরো। বুকে আগলে নাও পরম যত্নে।

শিক্ষার্থীদের জন্য মহামূল্যবান দু’টি কিতাব :

আমি তোমাদেরকে দুটো কিতাবের নাম বলছি। কিতাব দুটি লিখেছেন সিরিয়ান প্রখ্যাত আলেম আল্লামা আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.। অনেকেই হয়তো তাঁর নাম শুনেছো। তিনি সিরিয়ান আলেম হলেও হানাফী আলেম ছিলেন। রচনা করেছেন অসংখ্য কিতাব। আব্দুল ফাত্তাহ বলে তাঁর নাম রাখার পেছনে বড় চমৎকার এক প্রেক্ষাপট আছে। ‘ফাতহ’ মানে তো বিজয়, খুলে যাওয়া। তাঁর জন্মগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর বাবার ব্যবসায় অনেক বরকত হয়, তাদের পরিবারে অনেক প্রশস্ততা আসে এবং রিযিকের দরজাটা খুলে গিয়েছিলো। এজন্য বাবা এবং দাদা তাঁর জন্য এ নামটাকেই বেছে নেন। তো শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহর গুরুত্বপূর্ণ দুটি কিতাব আছে, ছাত্রদের জন্য আমি যে দুটি কিতাব পড়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করি। একটি কিতাবের নাম ”قيمة الزمن عند العلماء ‘উলামায়ে কেরামের কাছে সময়ের মর্যাদা’। এ কিতাবে আমাদের সফল আকাবির উলামায়ে কেরাম তাদের তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে, তাদের ছাত্রত্বকে মূল্যবান মনে করে সময়কে কীভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন, সে বর্ণাঢ্য ঘটনাগুলো এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম শাফেয়ী রহ. একটা কথা বলেছেন,

» الوقتُ كالسيف.. إن لم تَقْطَعْهُ قَطَعَك«

সময়কে যদি তুমি সুযোগ বুঝে ভালোভাবে ব্যবহার করো, তবে তো ভালো, নতুবা সময় তোমাকে কেটে ফেলবে, তোমাকে জবাই করে মেরে ফেলবে। অর্থাৎ একেকটি দিন তোমার অতিবাহিত হচ্ছে তো দেখতে হবে, তুমি কতটা কাজে লাগাতে পারলে। কাজে লাগিয়ে যদি সফল হতে পারো, তুমি মরেও যেন অমর হয়ে থাকতে পারবে।

তুমি ভেবে দেখো, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আজ পৃথিবীতে নেই, কিন্তু কত দূরে বসে, পটিয়ার মত একটি অঞ্চলে তাঁর নাম আজকে উচ্চারিত হচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে? সময়কে তিনি যথাযথ মূল্য দিয়েছিলেন, কাজে লাগিয়েছিলেন বলেই। তিনি যদি তা না করতেন, হেলায় ফেলায় কাটিয়ে দিতেন, এরকম মূল্যবান গ্রন্থ তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসতোনা, দিকে দিকে তাঁর নামও এভাবে আলোচনায় আসতোনা। এরও পূর্বে হাজার বছর আগেও যারা অতিবাহিত হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের নামও আমরা বারবার উচ্চারণ করি; ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমাদ, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ীসহ কত নাম আমরা বারবার বলি। অথচ শত শত বছর আগে তাঁরা পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন। সময়কে কাজে লাগিয়েছেন বলেই তাঁদের নাম আমাদেরকে বলতে হচ্ছে। সময়কে যদি অনর্থক আড্ডাবাজিতে ব্যয় করতেন তাঁরা, উম্মতের জন্য কোনো কিছু রেখে না যেতেন, কে বলতো মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস আশ শাফেয়ীর কথা। তিনি যদি কিতাবুল উম্ম না লিখতেন, যদি না লিখতেন কিতাবুর রিসালাহর মত কালজয়ী কিতাব, কে তাঁকে স্মরণ করতো। ইমামে আযম আবু হানিফা রহ.-এর কথা কে বলতো, যদি তিনি জগদ্বিখ্যাত একেকজন ছাত্রকে তৈরি করে না দিয়ে যেতেন! তাঁর কথাগুলো, তাঁর মাসআলা, উসূল এবং ফিকহের নানা দিকগুলো যদি তাঁর ছাত্ররা আল জামিউস সগীর, আল জামিউল কাবীর, আসসিয়ারুস সগির, আস সিয়ারুল কাবির, মাবসূত, যিয়াদাত, মুসনাদ ইত্যাদি কিতাবাদিতে সংকলন না করে যেতেন, উম্মাহর জন্য প্রোডাকশন করে না যেতেন, কে তাঁকে স্মরণ করতো আজ এতবছর পর এসে? সময়কে যথাযথ কাজে লাগানোর ফলে তাঁদের কলম থেকে বেরিয়ে আসা এসব কর্মের কারণেই আজ ইমামে আযম মর্যাদার এ আসনে জায়গা করে নিয়েছেন।

তো প্রিয় ছাত্রবন্ধু, তোমার হাতে এখন সময় নামক যে তরবারিটি আছে, সেটা এখন অনেক দীর্ঘ এবং প্রশস্ত। আমার তরবারিটা দেখো কত সংকীর্ণ হয়ে গেছে। তুমি সেটাকে যদি ব্যবহার করতে পারো, সফলতার সমুচ্চ সিংহাসন তুমি নিজের করে নিতে পারবে। সেইসাথে আরও একটা জিনিস তোমার লাগবে, সেটা হচ্ছে ‘ধৈর্য’। কিছু পেতে তোমাকে স্বীকার করে নিতে হবে অনেক কষ্ট এবং ত্যাগ। ধৈর্যের এ গুণ নিজের ভেতর স্থির করতে তোমার জন্য প্রয়োজন শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহর দ্বিতীয় আরেকটি কিতাব صفحات من صبر العلماء ‘ইলম অর্জনে উলামাদের ধৈর্যধারণের কিছু ইতিহাস’। প্রতিটি আলেম কত যে কষ্ট সহ্য করেছেন, আমরা ভাবতেও পারবোনা। আজ তাঁদের কথা আমরা পড়ি, হয়তো শিহরিত হই, কিন্তু সহজেই তাঁরা এ পর্যায়ে পৌঁছে যাননি। কষ্টের সবটা দিয়ে তাঁরা নিজেদেরকে এতটা মূল্যবান করেছিলেন। এ কিতাবগুলো খুঁজে খুঁজে তোমাদের পড়া দরকার।

ইসলমিক স্টাডিজ বিভাগ (আদ-দিরাসাতুল ইসলামিয়া) প্রতিষ্ঠা :

আল-জামিয়া পটিয়ায় ‘আদ-দিরাসাতুল ইসলামিয়া’-এর উপরে একটি শর্টকোর্স বিভাগ খোলা হয়েছে৷ এটিকে আমার জীবনের একটি সদকায়ে জারিয়াহ হিসেবে মনে করি আমি৷ হযরত হারুন সাহেব হুজুরকে বললাম, অনেক ছাত্ররা তাবলীগে যাওয়ার পর বা দ্বীনি বুঝ আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই তারা আলেম হতে চায়। এখন শুরু থেকে পড়লে তাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যায়। তাই যারা মেট্রিক পাশের পর আসতে চায় তাদের জন্য যদি সংক্ষিপ্ত একটা কোর্স করা যায়, অনেক বড় একটা কাজ হতো বলে মনে হচ্ছে৷ আলহামদুলিল্লাহ, এই পরিকল্পনাটা আমি প্রণয়ন করি এবং হুজুর সেটাকে অনুমোদন করেন তখন। নতুন ভবনের পেছনের দিকে পৃথকভাবে একটি শর্ট-কোর্স বিভাগ খোলা হয়৷ এর সংক্ষিপ্ত নাম দেওয়া হয়, আদ-দিরাসাতুল ইসলামিয়া, ইসলামিক স্টাডিজ। ইসলাম রিলেটেড যাবতীয় পড়াশোনা। শর্ট কোর্স তো এটার ডাক নাম। আসল নাম না। আসল নাম হলো আদ দিরাসাতুল ইসলামিয়্যাহ ফিল মানহাজিল মুজিয৷ তথা সংক্ষিপ্তভাবে পড়া। আলহামদুলিল্লাহ এই কাজ টা করার সুযোগ হয়েছে পটিয়াতে যখন ছিলাম।

হযরত হারুন ইসলামাবাদী সাহেবের সাথে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তখন। সেটা হচ্ছে একটা আল-বালাগ প্রকাশনী প্রতিষ্ঠা করা৷ তৃতীয় তলায় অফিস ছিল প্রকাশনীটির৷ আসলে অনেকগুলো কাজের সূচনা হয়েছিল এই অল্প সময়ে। বলতে গেলে আমি পরিপূর্ণভাবে এই জামিয়া পটিয়ায় ছিলাম মাত্র পাঁচ বছর। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭-এ মিশরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। তারপর ৩ বছর মিশরে অতিবাহিত করে আবার বাংলাদেশে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় সপ্তাহে দুইদিন আসতাম এখানে। তখন হুজুর জীবিত ছিলেন। এই সময়গুলোতে অল্প সময়ে বিস্তরভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। যেটা কিনা এখনো আমি মিস করি, যেটাকে ফিরে পেতে আমি এখনও উদগ্রীব বাসনা লালন করি।

জামিয়ার সন্তানদের নিকট বিশেষ নিবেদন :

আমি আমার প্রিয় ভাইদেরকে বলবো, আগামী প্রজন্মকে বলবো, নতুন প্রজন্মকে বলবো, তোমাদের সামনে চলার অনেক পথ বাকি আছে। পটিয়া মাদ্রাসাকে বাইরের মানুষ এসে বড় করবে না। পটিয়া মাদ্রাসার সৌরভ, পটিয়া মাদ্রাসার গৌরব, জাতীয় পর্যায়ে সেটা যতটুকু আছে তা আরও ছড়িয়ে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা, এসব তখনই সম্ভাবনার পথ তৈরি করবে যখন আমরা এর জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করব। আমরা যদি আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, ফরিয়াদ করি, এগুলো খুব তুচ্ছ ব্যাপার৷ পটিয়ার মত একটা আধো গ্রামাঞ্চল, আধো মফস্বল শহরে যদি এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে সেটা কি আল্লাহর বিশেষ সাহায্য না? এটা তো শহরের প্রাণকেন্দ্র নয়, মফস্বল একটা শহর। এখানে কীভাবে এত বড় একটি ইলমী উদ্যান তৈরি হয়ে গেলো? হ্যাঁ, এটা ছিল ইখলাস এবং লিল্লাহিয়্যাতের ফসল। ছিল অজস্র চোখের পানির বিনিময়।

তাই এই জামিয়াকে যদি আরও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে সমুন্নত করতে হয়, সেটা করতে হবে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং কার্যক্রমের মাধ্যমে। প্রায় শত বছরের ফারেগিন যারা আছেন, এবং বর্তমানে যারা পড়ছেন, তাদের সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জামিয়া পটিয়া অনেক উপরে উঠে যেতে পারে। এজন্য দরকার হলো আল্লাহর দরবারে আমাদের কান্নাকাটি করা। ইখলাসের সাথে কাজ করা৷ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে অগ্রসর হওয়ার মানসিকতা লালন করা৷

প্রাণভরে একটু শ্বাস নিতেই জামিয়ার আঙিনায় ফিরে আসা:

এই পটিয়া মাদ্রাসার আঙিনায় কীসের আশায় বারবার ফিরে আসি বলো তো তোমরা? প্রাণভরে একটু শ্বাস নিব বলে, আসি পবিত্র বাতাসে নিজেকে একটু শান্ত করব বলে, যে বাতাসে থাকবে আধ্যাত্মিকতার পরম পরশ, সাহচর্যের সৌরভ। যে বাতাসভরা মায়া এবং শুধুই মমতা। বুক ভরে সেই নিশ্বাসটুকু নেওয়ার জন্য আমরা পটিয়া মাদ্রাসায় আসি৷ শুধু আমি নই, হাজার হাজার আলেমরা সময়ে সময়ে এখানে আসেন৷ সৌরভমণ্ডিত পবিত্র বাতাস আলিঙ্গন করতে তারা দৌড়ে ছুটে আসেন৷ মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে আমাদের ফরিয়াদ থাকবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পবিত্র জামিয়ার আঙিনা, এবং এর বাতাসকে সবসময় যেন বিশুদ্ধ রাখেন, সবসময় যেন পবিত্র রাখেন৷ সবসময় যেন ইখলাসে পূর্ণ রাখেন৷ এখানে এসে যেন আমাদের মনটা ভেঙে না যায়। বরং অনেক বড় হয়ে যায় যেন আমাদের মন। ছাত্রদের উত্তরোত্তর সফলাতা, তাদের পড়াশোনা, আমল, ইখলাস, ইত্যাদি দেখে যেন আমরা যেন আমদের মনকে শান্ত করে তুলতে পারি৷ আল্লাহ যেন কেয়ামত পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানকে এভাবেই রাখেন। গায়েবী কুদরতের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের মান-মর্যাদা, সম্মান ও গৌরব অটুট রাখেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে আমাদের এটাই চাওয়া। মহান রাব্বুল আলামিন অবশ্যই এই প্রতিষ্ঠানকে হেফাজত করবেন৷ এবং সেটার যে আকাশসম মর্যাদা সেটাকে কেউ যেন ভূলন্ঠিত করতে না পারে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন সে ব্যবস্থাও করে দেন।

সদা জামিয়ার সুসংবাদের অপেক্ষায় থাকি :

দূর থেকে যখন পটিয়া মাদ্রাসার কোন গৌরবের কথা শুনি, যেমন, পুরো দেশে জামিয়া পটিয়ার একজন ছাত্র মেধাতালিকায় এসেছে, অথবা যখন দেখি বাংলাদেশের সকল মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে পটিয়া মাদ্রাসা সর্বোচ্চ ভালো ফলাফল করেছে, আমাদের মনটা এত্ত বড় হয়ে যায়৷ কেননা এই পটিয়ার সাথে তো আমাদের আত্মার সম্পর্ক৷ কিন্তু এর বিপরীতে যখন পটিয়া মাদ্রাসার কোনো নেতিবাচক সংবাদ আসে, আমাদের মনটা ছোট হয়ে যায়। আমাদের মাথাটা নিচু হয়ে যায়। অন্যদের সামনে, জনসমক্ষে, মুখ তুলতে ইচ্ছে করেনা আর।

তাই আমাদের করজোড় প্রত্যাশা থাকবে এই জামিয়ায় সকল ছাত্রদের প্রতি, তোমরা নেগেটিভ কোনো এক্টিভিটিতে জড়িয়ে পড়বেনা। বরং আমাদের মর্যাদাকে আরও সমুন্নত করে ধরবে। আমরা যেন ইউরোপসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে গিয়ে বলতে পারি, এই আমাদের জামেয়া, এখান থেকে আমরা ইলমে-আমলে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করে বের হয়েছি। বিভিন্ন পজিটিভ খবর, ভালো খবর, পটিয়ার নানামুখী অর্জনের খবর আমরা যেন ইউরোপের মানুষকে দিতে পারি৷ যেমনটি হযরত মুহতামিম সাহেব বলেছেন, পটিয়া মাদরাসার উপর ২৫ মিনিট দীর্ঘ একটি ডকুমেন্টারি আলহামদুলিল্লাহ তৈরি হচ্ছে। প্রায় সমাপ্তির পথে এর কাজ । পটিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পটিয়া মাদ্রাসার সৌরভ, পটিয়া মাদ্রাসার অর্জন, সবগুলো জিনিস এ ডকুমেন্টারিতে আছে। এটা এজন্য তৈরি করা হয়েছে, ইউরোপে যারা প্রবাসী বাংলাদেশিরা আছেন, তারা পটিয়া মাদ্রাসাকে ওভাবে চেনেন না। অন্যান্য বড় দ্বীনি ইদারা যেমন, হাটহাজারি মাদ্রাসা, বাবুনগর মাদরাসা ইত্যাদিকে সবাই যেমন একবাক্যেই চিনে ফেলে, পটিয়া মাদ্রাসা সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা না থাকায় সূচনাতেই চিনতে তাদের কষ্ট হয়। ইনশাআল্লাহ এই ডকুমেন্টারি স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় প্রচার হবে। সোশ্যালমিডিয়ায় জোরদার প্রচারণা চালানো হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে, ইউরোপ, ইউকে, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশেই ইনশাআল্লাহ ছড়িয়ে পড়বে৷ পটিয়া মাদ্রাসার গৌরব আরও বৃদ্ধি পাবে।

আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী সবসময় চেষ্টা করেছেন পটিয়াকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃত করে তুলতে। আল আযহার ইউনিভার্সিটি থেকে উস্তাজ এনেছেন। ডক্টর আব্দুল কাদের এসেছিলেন তখন আল আযহার থেকে। তিনি প্রায় দুই সপ্তাহের মতো এখানে পড়িয়েছেন, লেকচার প্রদান করেছেন৷ এরপর থেকেই আজহারের সাথে পটিয়ার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়৷ তিনজন শিক্ষককে ওখান থেকে প্রেরণ করা হয় আযহারের বেতনস্কেল অনুসারে। অন্যদিকে পাঁচজন ছাত্রকে এখান থেকে আজহারে প্রেরণ করা হয়। প্রথম বছর আমিও গিয়েছিলাম। এর মাধ্যমে একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যায় আরব বিশ্বের সাথে৷ পাশাপাশি অন্যান্য আরব বিশ্ববিদ্যালয় এবং সৌদি আরবের অনেক জামেয়ার সাথে হযরত হারুন সাহেব হুজুর মুআদালা সম্পন্ন করেছিলেন। এখন সময় এসেছে আরবের সাথে সাথে পশ্চিমা জগতে পটিয়া মাদ্রাসার পরিচয়কে সমুন্নত করার। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে, ইউরোপ থেকে সবখানে, মানুষকে দ্বীন শেখানোর। এজন্য তোমাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে৷ আমি আশা করি, আগামী দিনে, আমাদের সময়ে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে মুআদালা থাকায় যেভাবে আজহারে গিয়েছিলাম, তেমনি তোমরাও ইনশাআল্লাহ পাশ্চাত্যেও পৌঁছে যাবে উচ্চতর শিক্ষার জন্য এবং সেখানে দ্বীনের কাজ করার জন্য তোমরা স্যাটেল্ড হবে। এর মাধ্যমে প্রাচ্যের জ্ঞান, পটিয়া মাদ্রাসার জ্ঞান, ইলম, আমল এবং দাওয়াত ইনশাআল্লাহ ইউরোপের মাটিতে ছড়িয়ে দিবে৷ আমরা জানি, ইউরোপ হচ্ছে এখন ইসলামের জন্য এক উর্বর জমিন৷ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আবার ইসলামের সূর্যকে ইউরোপ থেকে, পাশ্চাত্য জগত থেকে উদিত করার পথ খুলে দিয়েছেন৷ সেখানে মিডিয়াগুলোতে ইসলামের বিরুদ্ধে বলা হয়৷ ইসলামকে মানুষ প্রচণ্ড ভয় পায়৷ ইসলামোফোবিয়া ওদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। মসজিদ দেখলে ভয় পায়, মনে করে মসজিদে বোমা আছে, মিসাইল আছে। এই ভয়কে দূর করার জন্য দায়ীরা কাজ করছেন৷ তারা ঘুরে ঘুরে বোঝাচ্ছেন যে না, ইসলাম ভয়ের জায়গা না৷ এ যেমন আমাদের মসজিদগুলোতে, আমাদের একাডেমি মাদ্রাসাতে, আমরা উন্মুক্তভাবে আমাদের কার্যক্রম চলমান রাখি। অমুসলিমরা মসজিদে এসে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন বইপত্তর পড়ে। এরই মধ্য দিয়ে অনেক অমুসলিমের মাঝে ইসলামের ভালোবাসাও প্রবেশ করে। একটি কিতাব কিছুদিন আগে আমেরিকা থেকে বের করা হয়েছে, কয়েক বছর আগে৷ ইংরেজিতে প্রকাশিত বইটি লিখেছেন এক অমুসলিম প্রফেসর। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, আমরা ইসলামের কথা শুনলেই ভয় পেয়ে যেতাম। মনে হত যে ইসলাম বা কুরআন মানে হলো জিহাদি বোমা তৈরি কলাকৌশল শেখার একটা মাধ্যম৷ একদিন একজন আমাকে বললেন, আপনি তো অনেক বড় একজন প্রফেসর, শিক্ষক৷ আপনি কি কুরআন পড়েছেন কখনো? বললাম যে, না, কুরআন তো কখনো পড়িনি৷ তখন তিনি আশ্চর্যের সাথে বললেন, এমন একটা বই আপনার পড়া হয়নি, যার উপর দেড় থেকে দুই বিলিয়ন মানুষ বিশ্বাস রাখে। এক মিলিয়নের মতো মানুষ পুরোটা বই শব্দে শব্দে মুখস্ত বলতে জানে। এরকম একটি বই একবারও পড়েননি, কেমন কথা এটি! আমি তার কথা শুনে লজ্জায় পড়ে গেলাম। পৃথবীর প্রত্যেক চারজনের মধ্যে একজন যে গ্রন্থটিকে নিজেদের বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু মনে করে, সে বইটি আমি পড়লাম না কেন! তৎক্ষনাৎ এর অনুবাদ সংগ্রহ করলাম। পড়া শুরু করলাম৷ আগেই বলেছি, আমার ধারণা ছিলো যে, কুরআনের ভেতরে নিশ্চয়ই বোমা বানানোর থিওরি জাতীয় কিছু থাকবে৷ অমুসলিমদের কীভাবে আক্রমণ করে করে মারতে হয়, সে শিক্ষাই হয়তো থাকবে৷ কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আমি পুরো কুরআন পড়ে ফেললাম৷ এর প্রতিটি সুরা, চ্যাপ্টার শুরু হওয়ার আগে দেখা গেলো চমৎকার ভালোবাসার বার্তা প্রেরণ করে বলা হচ্ছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। বলা হচ্ছে রহমানের কথা, রহিমের কথা, রহমতের কথা, ভালোবাসার কথা৷ কোথাও আমি কোন আঘাতের কথা তো পেলাম না। তখন তিনি তার কুরআনের এই জার্নি নিয়ে বইটি রচনা করেন৷

ইসলামফোবিয়ার বীজ উপড়ে ফেলতে জরুরি দাওয়াতী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে:

পৃথিবীর নানা প্রান্তে দানা বেঁধে ওঠা মানুষের ভুলগুলো এভাবে ধরে দেয়া দরকার। পৃথিবী থেকে ইসলামফোবিয়ার যে বীজ, তা উপড়ে ফেলা দরকার। সেজন্য প্রয়োজন অনেক ভালো ভালো দায়ী, যারা দ্বীন বাস্তবে বোঝে, দ্বীনকে জানে, অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের শিক্ষাটা আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার সক্ষমতা রাখে।

এমনকি মুসলমানদের নতুন প্রজন্ম যারা ইসলাম জানে না ,মা বাবা মুসলমান ছিল, ইসলামকে এখন তারা ভুলে বসেছে। দাওয়াত দিয়ে তাদেরকে আবারও ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। অনেকেই জানবে তোমরা, লন্ডনের একটি বড় গির্জায় গিয়ে আমরা সেটাকে মসজিদে রূপান্তর করেছি। অনেক বড় গির্জা ছিলো সেটি। এর বিপরীতেই একটি পার্ক ছিলো। পশ্চিমে তো সাধারণ পাবলিক প্লেসকেই পার্ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে বসে মানুষ মদ্যপান করে, আড্ডা দেয়, গল্প করে। আমাদের দেশে যেমন মানুষ চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। তো ওই রকমই একটি পার্ক আমাদের মসজিদের সামনে ছিল। ওই পার্কের পরিচালক ছিল যে ভদ্রলোক, সঙ্গত কারণে তাকে খুঁজে বের করে পরিচিত হলাম। তার নাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তার নাম ডেভিড আহমেদ। ডেভিড বলতে বুঝা যাচ্ছে যে সে অমুসলিম। কিন্তু তার সারনেইম আবার দেখতে পেলাম আহমদ। আমাদের কৌতূহল হলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম আহমদ কী করে হলো? সে জানালো, আমার দাদা পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন এবং দাদি ছিলেন ইংলিশ মহিলা। যেহেতু আমার দাদা একজন মুসলমান ছিলেন এবং দাদি ছিলেন একজন ইংলিশ মহিলা, তাই বেশিদিন বিয়ে টেকেনি। দাদা মুসলিম থাকায় তার নামের শেষের আহমাদ নামটি এখনও রয়ে গেছে।

এরকম অনেক ডেভিড আহমদ আছে পাশ্চাত্যের আনাচে-কানাচে, যাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। বোঝাতে হবে যে তোমার আসল জায়গা হলো আহমদ। ডেভিড তোমার আসল জায়গা না।

এজন্য দরকার শক্তিশালী অনেক দায়ী, যোগ্য আলেম, যারা দাওয়াতের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে পারবে হাজারো অমুসলিম। আমার বিশ্বাস, তোমরাই সে দায়ীদের কাতারে নিজেদেরকে যুক্ত করতে পারবে। তোমাদের ভেতর সে অপার সম্ভাবনা আমি দেখছি। আমি তো বলেছি তোমরা হলে চারা, বীজ। এ বীজ এতই উর্বর, এতই সম্ভাবনাময়, যেখান থেকে বড় বড় আলেম, জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস বের হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তোমরাই পারবে বর্তমান সময়ের প্রয়োজনগুলোকে সমাধান করতে এবং উম্মতকে, দিকভ্রান্ত এ মানবতাকে পথনির্দেশনা দিতে পারবে। সেরকম সম্ভাবনা তোমাদের মধ্যে লুকানো আছে। আমরা তোমাদের মধ্যে সে রিদম তৈরি করতে চাই, নার্সিং করতে চাই, যাতে করে তোমাদের মধ্য থেকে ভালো চারা নির্গত হয়। ওই চারা দিয়ে যেন পুরো পৃথিবীব্যপ্ত এক বৃক্ষের জন্ম হয়। তাই আমি আশা করব যে তোমরা মনোযোগের সাথে পড়াশোনা করবে।

মোবাইল বিহীন জীবন-যাপনের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন এবং এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুন :

এ যুগে মোবাইলবিহীন জীবনযাপন করা অনেক বড় একটি জিহাদ। পটিয়া মাদ্রাসায় এবং অন্যান্য মাদ্রাসাগুলোতে মোবাইল ব্যবহার করা যায় না। নিশ্চয়ই এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কারণ, আমাদের শায়খ, হযরত জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী প্রায়ই বলেন যে, পৃথিবীতে মোবাইলের চেয়ে বড় ফিতনা আর আসেনি। আলেম-জাহেল মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে যে ফিতনা কাবু করে দিয়েছে, সেটার নাম হচ্ছে মোবাইল। এর অনেক উপকারও রয়েছে। টিভি এখন মোবাইলে, সিনেমা এখন মোবাইলে, রেডিও এখন মোবাইল, ক্যালেন্ডার মোবাইলে, ক্যালকুলেটর মোবাইলে, টর্চ লাইট মোবাইলে, সর্বোপরি সবকিছুই এখন মোবাইলে আছে। সব প্রয়োজনই এখন মোবাইলের মাধ্যমে সমাধা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও এ থেকে ক্ষতির উপসর্গ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত। ঘন্টার পর ঘন্টা সোশ্যাল মিডিয়া মানুষকে খেয়ে ফেলছে। অনেক পরিবারকে ধ্বংস করছে। আখলাককে নষ্ট করে দিচ্ছে।

হযরত জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী (হাফি.) বলেন যে একজন হাফেজ আমার কাছে আসল। রুহানী অনেক গুণ ছিলো ছেলেটির। সে আমার কাছে এসে জানালো, জিকিরে এবং আমলে সে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন সে আর আগের মতো নেই। কিন্তু কেন সে এভাবে এসব থেকে ছিটকে পড়লো? অনেক বিশ্লেষণ করে জানা গেল, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে গিয়ে, হঠাৎ একদিন এমন একটি বিজ্ঞাপন তার সামনে আসলো, যেটায় ক্লিক করামাত্রই তার সামনে বিস্তৃত একটি নষ্ট জগত উন্মোচন হয়ে গেলো। যেসব দেখতে অনেক ভালো লাগে। নফস প্রশান্তি পায়। একপর্যায়ে খারাপ জিনিস দেখাটা তার নেশায় পরিণত হয়ে গেল। আর এ নেশার কারণে যে রুহানিয়াত তার ছিল, ইবাদতের যে মজা ছিল, সেগুলোকে সে হারিয়ে ফেলেছে। হ্যাঁ, এই মোবাইল তোমার ঈমানকে চুষে ফেলবে, আমলকে, নৈতিকতাকে চুষে ফেলবে, সময়কে চুষে ফেলবে। তাই এখন ফিতনামুক্ত যে সময় জামেয়ার ভেতরে তোমরা অতিবাহিত করার সুযোগ পাচ্ছো, এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। নিজেদেরকে বড় আলেমে পরিণত করতে আল্লাহর সাথে কানেক্টেড হয়ে অনেক বড় হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, মেহনত করতে হবে খুব বেশি বেশি। এবং সময়কে মূল্যায়ন করতে হবে সবচেয়ে বেশি। আমি আশা করব, এখানের প্রত্যেকটি ছাত্র পড়াশোনায় মনযোগী হয়ে উঠবে।

ওস্তাদের সাথে নেক সম্পর্ক রাখবে :

প্রত্যেক ছাত্রকে ওস্তাদদের সাথে নেক সম্পর্ক রাখতে হবে। এর মাধ্যমে তোমাদের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। তোমরা অনেক বড় হতে পারবে। এবং এটাও তোমাদের দায়িত্ব যে আসাতিযায়ে কেরামের জন্য দুআ করবে। যথাসাধ্য খেদমত করবে। আমরা যখন ছাত্র হিসাবে ছিলাম এখানে, আমাদের যারা ওস্তাদদের জন্য আমরা দিলভরে দোয়া করতাম। মুরুব্বীদের খেদমত করতে চেষ্টা করতাম। এমন করতাম না কখনও, একজনকে মুহাব্বত করছি বলে পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা লালন করব আরেকজনের ব্যাপারে, একজনকে ভালো লাগে বলে আরেকজনকে ঘৃণা করবো! এমনটি কখনোই আমরা করতাম না। সে সময় আমাদের হারুন ইসলামাবাদী সাহেব যখন দায়িত্বে ছিলেন, অনেক সময় অনেক ওস্তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বিমত থাকতো, কিন্তু সকল উস্তাদদের সাথে সমানভাবে সুসম্পর্ক আমরা বজায় রাখতাম। কেননা সব উস্তাদকেই আমাদের দরকার। একজনকে ভালবাসবো আর অপরজনকে ঘৃণা করব, এটা হতে পারে না। কোনো জায়গায় কোনো বেয়াদবির লিস্টে আমার নাম যেন না থাকে, সে ব্যাপারে সবসময় এলার্ট থাকবে। সব জায়গায়, সব উস্তাযের কাছে যেন আমি মুয়াদ্দাব ছাত্র হিসেবে লিস্টে থাকি, এটাই হবে আমার টার্গেট। সে সময় অনেক ছাত্র ভুল করত! অমুক ওস্তাদকে মহব্বত করে তার সাথে খুব আদব, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা দেখাত, অন্যদিকে আরেক উস্তাদের সাথে শুরু করে দিত বেয়াদবি। যার ফলে আরেক জায়গায় তার নাম বেয়াদবের লিস্টে এসে যায়। এজন্য আমরা যেন কখনোই বেয়াদব ছাত্রদের তালিকাভুক্ত না হয়ে যাই, সবসময় এ প্রচেষ্টাটাই করে যেতে হবে।

আদব কী, আখলাক কী, সুন্দর ব্যবহার কী— তা ভালোভাবে বুঝে আমাদের জীবনে এর প্রয়োগ করতে হবে, আঁকড়ে ধরতে হবে এর সবটা। কেননা এটা ইসলামেরই শিক্ষা। কিয়ামতের ময়দানে সবচেয়ে ভারী বস্তু হিসেবে যে জিনিসটিকে পাওয়া যাবে, সেটার নাম হচ্ছে আল খুলুকুল হাসানাহ বা সুন্দর ব্যবহার। তাই উস্তাদদের সাথ, ছাত্রদের সাথে, আমরা সুন্দর ব্যবহার করব। এবং আদবের সাথে হবে আমাদের সমস্ত ওঠা-বসা, চালচলন।

জামিয়া পটিয়ায় যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিত্তেই মুহতামিম নির্ধারণ করা হয় :

এই দোয়াটা আমাদের করে যেতে হবে আল্লাহ পাক যেন জামিয়ার যে ঐতিহ্য, সেটাকে আমাদের প্রচেষ্টার সবটুকু দিয়ে রক্ষা করার তাওফিক দেন। হযরত মুফতি আযীযুল হক সাহেব রহ. কখনোই নিজের কোনো সন্তানকে দায়িত্বে বসাতেন না। পটিয়া মাদরাসার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে তিনি খুঁজে এনেছেন সেই হাটহাজারির ইছাপুর থেকে হযরত হাজী ইউনুস সাহেব রহ.-কে। হাজী সাহেব হুজুর এ দায়িত্বে অনেকদিন ছিলেন। পটিয়াকে অনেক বড় করে তোলার জন্য মেহনত অব্যাহত রেখেছেন। এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেবামূলক কার্যক্রমের জন্য প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন, বিভিন্ন জায়গায় খ্রিষ্টান মিশনারী তৎপরতা রোধে নানামুখী দাওয়াতী কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। এত সুন্দর মেহমানখানা তখন কোথাও ছিলোনা, পটিয়াতে তিনি চমৎকার কলেবরে একটি মেহমানখানা নির্মাণ করেছেন। তারপর যখন দায়িত্বের একদম শেষলগ্নে পৌঁছে গিয়েছেন, খুঁজে এনেছেন আরেকজন মহারত্ন-কে। দায়িত্বের আসনে বসিয়েছেন হযরত হারুন ইসলামাবাদী রহ.-কে। তিনি চাইলে নিজের ছেলের জন্য এ চেয়ারটি বরাদ্দ দিতে পারতেন, তা করেননি। বরং জামিয়ার কল্যাণের কথা ভেবে, উম্মতের উপকারের কথা মাথায় রেখে, যাকে এখানে বসানো উপযুক্ত মনে করেছেন, তাকেই এনে বসিয়েছেন। হযরত হারুন ইসলামাবাদী রহ. তো অনেক অল্পসময় পেয়েছেন এই জামিয়ায়। একদম অকস্মাৎ তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন আল্লাহর কাছে। তারপরও দায়িত্ব অর্পণে তিনি এত সতর্ক ছিলেন যে, যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, চিকিৎসার জন্য ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে যাচ্ছেন, তিনি বললেন—’আমার অবর্তমানে তিনজন মিলে মাদরাসা পরিচালনা করবে। গাজী সাহেব হুজুর, কদীম সাহেব হুজুর এবং বুখারী সাহেব হুজুর রহ.। পরবর্তীতে হযরত বুখারী সাহেব হুজুরের উপর সে দায়িত্ব এককভাবে আসে। তেমনিভাবে হযরত বুখারী সাহেব হুজুরও যখন একদম জীবনের শেষ সময়গুলো পার করছিলেন, তিনি অনেক ইস্তিখারা এবং চিন্তাভাবনা শেষে একজন যোগ্য এবং জামিয়ার জন্য উপযোগী একজন কর্ণধারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। নিজ সন্তানদেরকে সামনে আনেননি। এটাই হচ্ছে কওমি মাদরাসার ঐতিহ্য, স্বকীয়তা এবং বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য সব জায়গায় কমবেশি স্বজনপ্রীতি হয়ে থাকে। কিন্তু পটিয়া মাদরাসা এটা প্রমাণ করেছে, যেমনি আল্লাহর রাসূল খিলাফত প্রদানের সময় ‘আমার পর আবু বকর হক্ব’ বলে প্রমাণ করেছিলেন ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। পটিয়া মাদরাসাও এ শিক্ষাকে ধারণ করে সবসময়ই উম্মতের কল্যাণচিন্তাকে অগ্রে রেখে দৃষ্টান্ত রেখেছে এবং রাখছে। সেইসাথে এ বিশ্বাসও আমাদের আছে, এগুলো সবই আমাদের আকাবিরের ইলহামী সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ। পটিয়ার সকল মুরব্বিদের উপর আমাদের সে আস্থা আছে। আমরা আশা করবো, এমন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের জামিয়াতে ঘটবেনা, যেটা আমাদের সোনালী ইতিহাসকে ধুয়েমুছে বিলীন করে দেয়। আমাদের মর্যাদাময় অতীতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।

তাই আমাদের উচিত তাদের জন্য দুআ করা। আল্লাহ আমাদেরকে সু-পরামর্শ প্রদানের তাওফিক দান করেন। জাতিকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করার তাওফিক দান করেন। তাঁদের হাত ধরে যেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ জামিয়া পৌঁছে যেতে পারে। ইখলাসের মাধ্যমে, চোখের পানির মাধ্যমে এ জামিয়া ইনশা আল্লাহ অনেক দূর পৌঁছে যেতে সক্ষম হবে। পরিশেষে আমি আরও একটি দুআ আল্লাহর দরবারে করতে চাই, আল্লাহ যেন আমাদের মুরব্বীদের ছায়া আমাদের উপর আরও দীর্ঘায়িত করেন। জামিয়ার সংশ্লিষ্ট সবাইকে ইখলাসের উপর অবিচল থেকে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জামিয়াকে সফলতার চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যেতে ভরপুর সাহায্য করেন। আমিন।

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on skype
Skype
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সংবাদ

নোটিশ