শর্টকোর্স বিভাগে তারকীবী মুনাযারা অনুষ্ঠিত

শর্টকোর্স বিভাগে তারকীবী মুনাযারা অনুষ্ঠিত

আজ ৮ ই যিলক্বদ ১৪৩৯ হিজরী মোতাবেক ২২ জুলাই ২০১৮ খৃষ্টাব্দ রোজ রবিবার আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার শর্টকোর্স বিভাগে তারকীবী মুনাযারা’ (কুরআনের আয়াতের বাক্য-বিশ্লেষণ বিতর্ক অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠিত হয়।  সকাল ৭ ঘটিকার সময় পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। অনুষ্ঠানের সূচনা ও উদ্বোধনী আলোচনা পেশ করেন জামিয়া পটিয়ার শিক্ষা পরিচালক ও সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি জসিমুদ্দিন কাসেমী হাফিজাহুল্লাহ

জনাব কাসেমী তাঁর উদ্বোধনী আলোচনায় বলেন,  আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো পবিত্র কুরআন-হাদিস এবং ফিকহের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করা। তবে এই বিষয়গুলোর উপর পরিপূর্ণ দক্ষতা ও পরিপক্কতা অর্জনের জন্য আমাদেরকে ভূমিকা স্বরূপ আরো কিছু শাস্ত্র পড়তে হয়। এই জন্য আমাদের দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মানতিক, ফালসাফা এবং নাহু-সরফও শিক্ষা দেয়া হয়। এই শাস্ত্রগুলো আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো কুরআন এবং হাদিসে পাণ্ডিত্য অর্জন করা। তবে কুরআন –হাদিসে পাণ্ডিত্য অর্জনের পূর্ব শর্ত হলো,  আরবি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন করা।  কারণ, আমরা অনেক জেনারেল শিক্ষিত ভাইদেরকে লক্ষ্য করেছি যে, তাঁরা কুরআনের অনুবাদ শিখে অনুবাদ তো বলতে পারেন,  কিন্তু যখন তাঁদেরকে শব্দ বিশ্লেষণ কিংবা বাক্য বিশ্লেষণ করে অনুবাদ করতে বলা হয় তখন তারা তা করতে পারেন না।

উদহারণ স্বরূপ বলা যায়, আল-হামদুলিল্লাহ’ শব্দের অনুবাদ করা হয় ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য’ তবে তাঁদেরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, অনুবাদে যে ‘সকল’ ব্যবহার করেছেন তা কোন শব্দের অর্থ? তখন তারা কোন উত্তর দিতে পারেন না। অথচ আমাদের ওলামায়ে কিরাম বলতে পারবেন এটি আলিফ লাম’ এর অর্থ। কারণ, তাঁরা আলিফ লামের ব্যাখ্যা ও প্রকার পড়েছেন।

তেমনি যেকোন শাস্ত্র পড়ার পূর্বে তার ভূমিকা স্বরূপ অনেক সংশ্লিষ্ট বিষয়ও পড়তে হয়। অন্যথায় আলা ওজহিল বাছিরাতিল কামেলা’ বা পূর্ণ দক্ষতার সাথে ঐ শাস্ত্রকে আয়ত্ব করা যায় না।  যেমন শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা’ নামক কিতাবে শরিয়তের হিকমত ও দর্শন শাস্ত্রের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন,

اذبه يصيرالإنسان على بصيرة فيماجاءبه الشرع، ويكون نسبة بتلك الأخباركنسبة صاحب العروض بدواين الأشعارأوصاحب المنطق ببراهين الحكماء، أوصاحب النحوبكلام العرب العرباء (حجة الله البالغة: جـ1صـ22)

এই শাস্ত্রের মাধ্যমে মানুষ শরিয়তের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপক্কতা লাভ করতে পারে। এটি কবিতার নিয়মনীতি সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির ন্যায়। অর্থাৎ কবিতার নিয়মনীতি সম্পর্কে একজন জ্ঞাত ব্যক্তি যেভাবে কবিতার মান নির্ণয় ও কবিতার অর্থ নির্ধারণ করতে সক্ষম হয় তেমনি কবিতার নিয়মনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে তা কখনো সম্ভব হয় না। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি মানতিকের নিয়মনীতি জানবে সে যেভাবে মানতিকের পরিভাষায় লিখিত কিতাবাদি ভালভাবে বুঝবে, যে মানতিকের নিয়মনীতি জানে না সে কখনো সেভাবে তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। যেমন আমাদের সিলেবাসে ‘শরহে আকায়েদ’ আছে। এই কিতাবটি লিখা হয়েছে মানতিকের পরিভাষা ব্যবহার করে। এখন কোন ব্যক্তি যদি মানতিক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে তা পড়ে সে যেভাবে তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে,  যে ব্যক্তি মানতিক বুঝে না তার পক্ষে তা হৃদয়ঙ্গম করা কখনো সম্ভব হবে না। তেমনি যে ব্যক্তি আরবী ভাষার গ্রামার ‘ইলমে নাহু’ ভালভাবে আয়ত্ব করতে সক্ষম হবে না, সে আরবি ভাষা ভালভাবে বুঝতেও সক্ষম হবে না। আর আরবী ভাষা ভাল করে না বুঝলে কুরআন-হাদিসও ভালভাবে বুঝতে পারবে না। তাই আমাদের সিলেবাসে ইলমে নাহুর গুরুত্ব অপরিসীম।

আমাদেরকে এই জামিয়ার প্রবীণ মুহাদ্দিস হযরত নুরুল ইসলাম জদীদ সাহেব রহ. দরসে বলতেন, আমাদের দাওরায়ে হাদিসে এমন কিছু ছাত্র আছে যারা ‘ইবারত’ (আরবী মূলটেক্স) পড়ার সাথে সাথেই অর্থ বুঝতে পারে। থেমে থেমে সুন্দর করে ‘ইবারত’ পড়ে। কিন্তু অনেক ছাত্র না বুঝে ‘ইবারত’ পড়ে থাকে। তাই তাদের ‘ইবারতে’ দাঁড়ি-কমা ঠিক থাকেনা। তাই পুনরায় সেই ইবারতের অর্থ ও ব্যাখ্যা পড়াতে হয়। এটি মূলতঃ ইলমে নাহুতে অপরিপক্ক হওয়ার কারণেই হয়ে থাকে।

এই তারকীবী মুনাযারার মূল লক্ষ্য হলো ইলমে নাহুর প্রেক্টিকেল অনুশীলন করা। এখানে পবিত্র কুরআনে কারীমের তারকীব-বাক্যবিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা হয়। যাকে আরবীতে ‘ইরাব’ বলা হয়।

আজ আমরা এমন একটি পবিত্র কুরআনের তারকীবী অনুষ্ঠান আরম্ভ করতে পেরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।  এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়।  পবিত্র কুরআনের যথাযথ অর্থ ও মর্ম উদ্ঘাটন করা ও তার প্রকৃত তাফসীর বুঝার জন্য আমাদেরকে আরবি ভাষার প্রধান মেরুদণ্ড ‘ইলমে নাহু’তে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যদি আমরা ইলমে নাহুতে দক্ষতা অর্জন করতে পারি তবেই কুরআন-হাদিসের তারকীব, তাহকীক, শানে নুযুল, তাফসীর ইত্যাদি বুঝতে সক্ষম হবো। আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানকে যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করার তাওফীক দান করুন, আমীন।

উল্লেখ্য যে, প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও জামিয়া পটিয়ার বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রদের অনুশীলন মূলক  মুনাযারা অনুষ্ঠিত হয়। জামাতে নুহুমের শিক্ষার্থীরা ‘তায়সীরুল মুবতাদী’ কিতাবের মুনাযারা করেছে। জমাতে হাস্তুম ও শর্টকোর্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা ‘মিযান’ এবং  জামাতে হাফ্তুমের শিক্ষার্থীরা ‘নাহ্ মীর’ কিতাবের মুনাযারা করেছে। জামাতে শাশুমের ছাত্ররা ‘হিদায়াতুন্নাহু’ এর সাথে কুরআন মাজীদের তারকীবী মুনাযারা করেছে। সর্বশেষ শর্টকোর্স বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্ররা প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও তারকীবী মুনাযারায় অংশগ্রহণ করেছে।

মূলতঃ এই ধরণের মুনাযারা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কোমলমতী ছাত্ররা; যারা এখন যথানিয়মে তফসীরের কিতাবাদী পড়ার সুযোগ পায়নি তারাও ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। যখন তাদেরকে ‘তাফসীরে রূহুল মা’আনী, ‘ইরাবুল কুরআন’, ‘ইমলাউ মা মান্না বিহির রহমান’ ইত্যাদির মত গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি পড়ে কুরআন মাজিদের এরাব ও তারকীবী এবং বাক্যবিশ্লেষণ ও সমাধান বের করতে দেখা যায়, তখন অন্তরে এক অপূর্ব আনন্দ অনুভূত হয়।  অন্তর থেকে দোয়া আসে আল্লাহ যেন এমন মেহনতী ছাত্রদেরকে কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ইলম দান করেন এবং দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত রাখেন, আমীন।

মহান প্রভুর দরবারে রিয়াদ করি তিনি যেন এমন ইলমী উপকৃত হওয়ার দ্বারগুলো আমাদের জন্য উন্মুক্ত রাখেন। জামিয়ার সকল উপকারী বিভাগকে সজীব এবং সচল রাখেন। জামিয়ার পরিচালকসহ যে সকল মুরব্বিগণ অসুস্থ তাঁদেরকে হায়াতে তায়্যিবা ও সুস্বাস্থ্য দান করেন, আমীন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on skype
Skype
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সংবাদ

নোটিশ